শিল্পী পালিত ঃ আজ খবরের ঘন্টার আত্মকথা বিভাগে আমরা শিলিগুড়ি মহকুমার ফাঁসিদেওয়ার সঙ্গীত শিল্পী রমেশ চন্দ্র রায়ের আত্মকথা মেলে ধরছি—
আমার নাম রমেশ চন্দ্র রায়। শিলিগুড়ি সংলগ্ন ফাঁসিদেওয়ার ছোট সুদামগছে আমার জন্ম, বড় হয়ে ওঠা। আমার বাবার নাম শ্রী চিন্টু মোহন রায়। মায়ের নাম শ্রীমতী কম্পেশ্বরী রায়। আমার বাবা খুব ভাল যাত্রা করতেন ,সাথে গানও গাইতেন। আমার দাদা মনমোহন রায় গান গাইতেন। বাড়িতে সাধু সন্তেরা আসতেন। চলত কীর্তনের আসর। আমাদের গুরুদেব স্বামী নিগমানন্দের সংঘ, সম্মিলনীতে বাবা, দাদার সাথে আমিও কীর্তন গাইতাম। বাড়ির পরিবেশটাই ছিল কীর্তনের পরিবেশ। একটু বড় হয়ে ভারত সেবাশ্রম, গৌড়ীয় মঠে আমার অনেক ডাক আসত হরিকীর্তন, গুরুকীর্তন গাওয়ার জন্য। ছোটথেকেই কীর্তনের ওপর আমার আগ্রহ বেশী। দিনহাটার উমাকান্ত রায় বর্মনের কাছে ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি গানের তালিম নিই। উনি একজন বেতার শিল্পী ছিলেন। বেশ কিছুদিন গান শেখার পর আমিও অডিশন দিয়ে সুযোগ পেলাম রেডিয়োতে গান গাওয়ার। নিয়মিত গান গাইতাম। সে সময়ে পাগলাহাটের এক বিচিত্রানুষ্ঠানে আমার গাওয়া গান মানুষকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে আজও তারা সে দিনের কথা বলে আনন্দ অনুভব করে। সে সময় থেকেই আমি নিজের লেখা গানে নিজেই সুর দিয়ে গাইতাম। মানুষের খুব ভাল লাগত আমার গান । সেই সুবাদে একবার কাটিহারে রেলওয়ে বিভাগের বিশ্বকর্মা পূজো উপলক্ষে গানের জন্য ডাক পাই। অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসার পরের দিনই খড়িবাড়িতে একটা সীমাবল সুরক্ষা বিভাগের অনুষ্ঠান ছিল। দিল্লী থেকে ডাইরেক্টর ও অন্যান্য বড় অফিসাররাও উপস্হিত ছিলেন। সেখানে আমাকে জোর করেই উদ্বোধনী গান গাওয়ার জন্য বলা হয়। সেও নাকি ওপরওয়ালার নির্দেশ। সেই গান হবে সীমাসুরক্ষাবল বাহিনীর দর্শন ও দেশমায়ের ওপর গান ।একদিনের মধ্যে সেই মত গান লিখে সুর করে গুরুদেবের নাম স্মরণ করে গাইলাম। আমি তো বাংলায় গাইছিলাম। সে সময় আমার গানের ইংরেজী তর্জমা করে ডাইরেক্টর সাহেবকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন কোন একজন। অনুষ্ঠান শেষে আমার ডাক পড়ল ডাইরেক্টরের ঘরে। আমাকে কিছু প্রশ্ন করে আমাকে প্যারা মিলিটারিতে ফৌজিতে নিয়োগ করেন। আমাকে আসাম প্রদেশে পোষ্টিং দেওয়া হয়। সে সময় আমি নিয়মিত বেতার শিল্পী, প্রচুর ছাত্র ছাত্রী ছিল। সে কারণে দূরে চাকরী নিয়ে যেতে মন চাইছিল না। বেতারে নাটকের নেপথ্য সংগীতও গাইতাম। আমার লেখা পরিবার পরিকল্পনার ওপর একটা একাংক নাটক বেতারে পরিবেশিত হয়। সেটা ছিল ১৯৭০ সাল। বাবার কথায় চাকরী নিয়ে আসামে গেলাম। শিলচর, হরিদ্বার, উত্তরাখণ্ড, প্রয়াগ, চেন্নাই, অমৃতসরের স্বর্ণ মন্দিরে ব্লু স্টার এ্যাকশনের সময়, কাছেই ওয়াঘা বর্ডারে ডিউটি, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর দিল্লী যেতে হয়েছে, চীন বর্ডার বোমডিলায়, পাকিস্তান বর্ডারে নানান কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। সে সব সময়ে বন্দুকই সঙ্গী । বাড়ির কথা মনে আসার সময় ও হত না।
আমার জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল এস, এস, বির একটা গানের আসরে সেটা ৭৩/৭৪ সাল হবে। সেই আসরে আই, জি উপেন বিশ্বাস মহাশয় যিনি অনগ্রসর কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন, তিনি এবং আরও বড় বড় অফিসাররা ও উপস্হিত ছিলেন। আসরে আমি একাই গান গাইছিলাম। আমি জন্মদাত্রী মায়ের গান গাইছিলাম। উপেন বিশ্বাস মহাশয় আমার গান শুনে অঝোরে কাঁদছিলেন। এরপর আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। আরও একবার ৭৭/৭৮ সালে ময়নাগুড়ির বিডিও সাহেব তখনকার পরিবেশের ওপর গান গাওয়াতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। নিজের লেখা নিজের সুরে গান গাইতেই বেশী পছন্দ করি। মালদায় মাঝে মাঝে প্রোগ্রাম করতে যাই। উপেন বিশ্বাস মহাশয় তার চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর “ রজনীগন্ধা “ নামে একটি দল গঠন করেছিলেন। সেখানে বিভিন্ন প্রদেশের লোকগীতি, পল্লীগীতি র গায়কেরা ছিলেন । আমিও সেই দলের সদস্য। নানান জায়গায় গান গেয়েছি । মালদায় খুব বেশী গানের জন্য যাই।উপেন বিশ্বাস মহাশয় ও তার পরিবারে সকলেই খুব সংগীত প্রেমী । রাজীব গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকা কালীন সারা ভারত নাচ গানের একটা কম্পিটিশন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রাজীব গান্ধী সপরিবারে আমন্ত্রিত ছিলেন। সেখানে আমি “ রজনীগন্ধার “ হয়ে গান গাই। ২০১৩ সালে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির উদ্যোগে আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতির সাতদিনব্যাপী গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল । তখনকার কৃষিমন্ত্রী নিজে আমার ফোনে যোগাযোগ করেন ও সমস্ত পারিতোষিক দিয়ে আমাকে কলকাতায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে বলেন । গান গাওয়ার জন্য আমি আমার গানের সাথে যারা সঙ্গত দেবেন সকলের জন্য রাজবংশী সম্প্রদায়ের বিশেষ পোষাক কি হবে , কেমন হবে তা নির্বাচন করে দেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ডঃ দীপক রায়। সাতদিন ধরে সে অনুষ্ঠান চলেছিল। ২০১৯ এ সি সি এন আয়োজিত একটা ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি, বাউল গানের রিয়্যালিটি শো তে বিচারক ছিলাম।আমার ইচ্ছে যেখানে যা কিছুই শেখ না কেন নিজের নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি কে নিজেরাই ধরে রাখবে।