নেই, সেই আগের আকাশ আর নেই — ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে লিখেছেন বিপাশা চট্টোপাধ্যায়

শিল্পী পালিত ঃ আজ ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে আমাদের এই ওয়েবপোর্টালে কলম ধরেছেন বর্ধমানের বিপাশা চট্টোপাধ্যায় —

বাঙালি মানেই বারো মাসে তেরো পার্বণ !! সেই তেরো পার্বণের একটি অন্যতম পার্বণ হল ঘুড়ির মেলা। বেশিরভাগ জায়গাতেই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এই ঘুড়ির মেলা বা ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব প্রচলিত হলেও, আমাদের বর্ধমান শহরে মকর সংক্রান্তির দিন এই ঘুড়ির মেলা বসে।

প্রতিবছর আগের দিন সন্ধে থেকেই চারিদিক থেকে পাঁচমিশেলী মাইকের চ্যাঁ ভ্যাঁ শুরু হয়, রাত যত বাড়ে আওয়াজও তত জোরদার হয়। সেই আওয়াজ শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়া। আর আজকের দিনে সকালবেলায় ঘুম ভাঙে মাইকে তারস্বরে পুরোনো দিনের জগঝম্প হিন্দি গানের খিচুড়ির ফাঁকে ফাঁকে, “ভোওক্কাটা, ভোওক্কাটা, ভোকাট্টাআআ” হাঁকডাকে। ঘুড়ি ওড়াতে পারতাম না কোনদিনই, কিন্তু এই দিনটির এক অমোঘ আকর্ষণ ছিলো ছোটবেলায়!! ছোটবেলায় দেখতাম, ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হত ঘুড়ির মেলার প্রায় মাস খানেক আগে থেকে! কত রকমের ঘুড়ি !! শতরঞ্জ, পেটকাটি, তিলকধারী, চাঁদিয়াল, পাশবগ্গা আরও কত কী!! সাইজ অনুযায়ী এক তাইয়া, দু তাইয়া, তিন তাইয়া, এমনকি ঢাউস পাঁচ তাইয়া ঘুড়িও উড়ত ঘুড়ির মেলার বিশেষ দিনটিতে।

বেশ কিছুদিন আগে থেকে শুরু হত পাড়ায় পাড়ায় ছেলেদের সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া। বাপরে সে কী পর্ব! হামানদিস্তায় কাঁচ গুড়ো করে তার সঙ্গে গঁদের আঠা, রঙ আর কি কি জানি মিশিয়ে তৈরী হত মাঞ্জার লেই। একজনের হাতে থাকত সুতোর গুলি আর তার একপ্রান্ত বাঁধা হত লাটাইএ। মাঝে একজন বসতো হাতে ঐ লেইএ ডোবানো কাপড়ের টুকরো নিয়ে। সেই মাঞ্জার লেই এর মধ্যে দিয়ে সুতোটা পার করে লাটাই ধারী চলে যেত অনেকটা দূরে, অনেকসময় দেখতাম পুকুরের এপ্রান্তে আর ওপ্রান্তে দুজন সুতোর দুই দিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে,একজন ছাড়ছে আর আরেক জন মাঞ্জাচর্চিত সুতোকে লাটাইএ গোটাচ্ছে।তারপর কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে তৈরি হত হোমমেড কড়কড়ে মাঞ্জা!! ঘুড়ির দামও হত সেই রকম, যে সময়ের কথা বলছি, অর্থাৎ আমি যখন নেহাতই ছোট, ভাই এর জন্য মাঝে মাঝে ঘুড়ি কিনতে হত ,তখন দেখতাম একটাকা, দুটাকা, পাঁচ টাকা, আর দশটাকা মানে তো বিরাট ব্যাপার!!

তখন ছেলেপুলেদের পড়াশোনাটাও বোধহয় কোনো চাপের ব্যাপার ছিলো না , নাহলে সারাদিন ঘুড়ি ওড়াতোই বা কারা!! আর প্রতি পাড়ায় দেখা যেত একদল ছেলেছোকরাকে ,তাদের মধ্যে নাকে পোঁটা পড়া কুচোও যেমন থাকত, তেমনি সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা তাল তেড়েঙ্গা, সারা গায়ে পায়ে ধুলো মাখা কিছু বিচ্ছু ছেলেও থাকত, যারা হাতে একটি করে লিকলিকে তালগাছের মতো লম্বা লগি নিয়ে আকাশমুখো হয়ে সারাদিন কেটে যাওয়া ঘুড়ির সন্ধানে এপাড়া ওপাড়া ছুটে বেড়াত ! এই সময় ছেলেদের মুখের অবস্থা গুলো খাসা দেখবার মতো হত একেবারে!! রোদে রোদে ঘুড়ি উড়িয়ে মুখ গুলো পুড়ে ঝামা, তার মধ্যে শীতের হাওয়ার টানে গাল ফেটে, ঠোঁট ফেটে এক্কেবারে যেন মুখপোড়া বাঁদর হয়ে উঠতো একেকটি!! আর ছাদে যাদের ফুলগাছ থাকতো তাদের অবস্থা সেই সময় বড়ো করুণ!! কারণ ঘুড়ি ওড়ানোর সময় তো সবাই বাহ্যজ্ঞানরহিত ! যখন প্যাঁচ লড়া হচ্ছে তখন তো সাঁই সাঁই করে সুতো টানা হচ্ছে, সে সুতো যে কোনদিকে ছড়াচ্ছে, সেদিকে তখন চোখ রাখে কে !! তারপর যেই সুতো ছাড়বার দরকার হল অমনি ছাদময় ছড়িয়ে থাকা সেই সুতো সর সর করে হাওয়ার টানে উঠতে থাকলো ওপর দিকে , সেই সঙ্গে কচ্ কচ্ করে কড়কড়ে মাঞ্জাতে কাটতে লাগল গোলাপ গাছের ডাল, চন্দ্রমল্লিকার ফুল সমেত ধড়, ডালিয়ার মস্তো মুন্ডু!! দিনের শেষে হায় হায় পড়ে যেত অনেক বাড়ির ছাদেই।

এই করতে করতে আসত বহু প্রতীক্ষিত ঘুড়ির মেলার দিন। সেদিন তো সকাল থেকেই সাজো সাজো রব!! ছাদে ছাদে মাইক, বক্স নিয়ে এক একেকটি দল তৈরী। মজুত করা হত পর্যাপ্ত ঘুড়ি, লাটাই লাটাই সুতো। কোন কোন ছাদে আবার দড়ি টাঙিয়ে তাতে লাইন দিয়ে সাজিয়ে রাখা হত ঘুড়ি গুলো। একটা কাটলেই আরেকটা উড়বে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গানের কিম্বা বলা ভালো আওয়াজের গুঁতোয় কান পাতা দায়, তার মধ্যেই থেকে থেকে শোনা যেত, ‘ভোওক্কাটা’…’পেটকাটি লড়েনাক্কোওওও’… ‘নীল তিলকধারী ভোওক্কাটাআআ’… ‘দুয়ো, দুয়ো, চাঁদিয়াল বাড়েনাক্কোওও ‘…’ওরে পাগলা… বাড়া, বাড়া, পালাচ্ছিস কেন!! ‘…ইত্যাদি ইত্যাদি আস্ফালন।

সেদিন এই সুযোগে যার যেখানে যতো খেপানোর বা রাগানোর পাত্র থাকত, সব্বাইকে মনের সুখে মাইকে পাড়া কাঁপিয়ে যা খুশি বলে নিতো!! শুধু ছেলেরাই যে ঘুড়ি ওড়াত তা তো নয়, ঘুড়ি ওড়াক বা না ওড়াক প্রায় সব ছাদেই প্রমীলা বাহিনীর বিশেষতঃ কিশোরীদের উপস্থিতি বেশ ভালোই থাকত !! শুধু ঘুড়িই নয়,চারিদিক থেকে কাছে দূরে কতো যে উৎসুক চোখের চোরা চাহনি মিষ্টি মিষ্টি প্রজাপতির মতো রঙবেরঙের ঘুড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে উড়তে থাকত তার ইয়ত্তা নেই!! কেটে যাওয়া ঘুড়ি যখন ছাদের ওপর দিয়ে উড়ে যেত , তখন তার প্রায় অদৃশ্য সুতোটাকে ধরতে পারার আনন্দটা ,গুপ্তধন পাবার থেকে বোধহয় কিছু কম হত না!!

বিকেলের দিকে দেখা যেত, যে সব ছাদে একটু হোমড়া চোমড়া উড়িয়েদের ভীড়, সেখানে নীচ থেকে দফায় দফায় চা, চা এর সঙ্গে নানারকম টা উঠছে !! সব মিলিয়ে নাচ ,গান ,হৈ হুল্লোড়, শীতের শনশনে বাতাস, মিঠে কড়া রোদ, সবমিলিয়ে দারুণ একটা পিকনিক পিকনিক উৎসবের আমেজ !! সেদিন আর কিছুতেই নীচে থাকতে ইচ্ছে করত না, মন পড়ে থাকত ছাদে। মায়ের কাছে কোনরকমে সেদ্ধ পুলির ধার গুলো মুড়ে দিয়েই (এইটা খুব সুন্দর করে করতে পারি,নিজ মুখেই বলছি) ছুটতাম ছাদে। আকাশ জুড়ে থিক থিক করছে রঙ বেরঙের পাখির মতো ঘুড়ি, তার মধ্যে চারিদিক থেকে বক্সে নানারকম মজার মজার কমেন্ট, কখনো কখনো মাইকের মধ্যেই এপাড়া ওপাড়ার মধ্যে ঝগড়া, উফফ্ সে যে কী মজাদার দিন কাটত বলার নয় !!

কোনো এক বছরের কথা মনে পড়ে, সেবার আমাদের বাড়ি থেকে একটু দূরে একটা বাড়ির ছাদে বেশ কয়েকজন বড়ো বড়ো দাদা ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলো। দিনের শেষে নেমে যাবার আগে, তারা পড়ে থাকা ঘুড়ি গুলো ফাটিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল, আর তো ওগুলো লাগবে না! ভাই তখন খুবই ছোট , ওর সে কী ছটফটানি!! মনে হচ্ছিল ঐ দাদারা, ঘুড়ি গুলো নয় ওর বুকটাকেই বুঝি ফাটিয়ে দিচ্ছে!! ওর সেই আকুল ছটফটানি আজও আমার চোখে ভাসে!! আমার বাড়ির পাশে বাঁকা নদী। নদীর ওপাড়ে বিরাট খোলা মাঠ। সেখানে রীতিমতো মঞ্চ বেঁধে ঘুড়ি ওড়ানোর আসর বসতো!! দিনের শেষে সেই মঞ্চ থেকে এ্যানাউন্সমেন্ট শোনা যেত, “মা বোনেরা, যাদের কাঁথা সেলাই করার জন্য সুতোর দরকার, তারা দলে দলে এসে আমাদের মঞ্চ থেকে সুতো সংগ্রহ করে নিয়ে যান !!”

এই রকম কত যে টুকরো টুকরো ছবি জড়িয়ে আছে ঘুড়ির মেলার দিনটিকে নিয়ে!! আস্তে আস্তে বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে কখন যেন ফিকে হয়ে আসতে লাগলো মাইকের হল্লাগোল্লা কিম্বা ‘ভোওওক্কাটাআআ’র আকর্ষণে ছাদে দৌড়ে যাবার সেই টান, কমতে লাগলো লগা নিয়ে আকাশমুখো হয়ে এপাড়া ওপাড়া দৌড়ে বেড়ানো ছেলের দল, জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দামের সঙ্গে সঙ্গে কমতে লাগলো আকাশ জোড়া রঙবেরঙের ঘুড়ির বাহার।

তবে সেই মনটা এখনও বোধহয় কোথাও রয়ে গেছে আনাচেকানাচে,তাই আজকের দিনে সকালে মাইকে ভোওক্কাটা ,ভোওক্কাটা শুনলে এখনও মনে হয় একবার অন্ততঃ ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে চোখটা রাখি! আজও তাকালাম, ইতস্ততঃ কিছু ঘুড়ি উড়ছে বটে, মাইকও বাজছে কাছে দূরে, কিন্তু নেই, সেই আগের আকাশ আর নেই!! সেই আনন্দ মাখা আকাশ আজ আর নেই। তবু, আধগ্লাস জলকে চিরকাল অর্ধেক খালি না ভেবে অর্ধেক ভর্তি ভেবে আসা আমি, এটা ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিলাম, যাক গে, নাই বা উড়লো অত রঙবেরঙের ঘুড়ি, কিছু পাখি তো অন্ততঃ বাঁচলো ঐ মাঞ্জা সুতোর প্যাঁচে পড়ে জীবন খোয়ানোর হাত থেকে!! জীব শ্রেষ্ঠ আমরা, আমাদের আনন্দ যে কত নিরীহ অসহায় প্রাণীর মৃত্যু ফাঁদ , সেটা তো এমনিতে আমরা মনে রাখি না, না হয় প্রকৃতিদেবী এভাবেই নিজের সন্তানদের একটু রক্ষা করলেন!!

বিপাশা চট্টোপাধ্যায়
তেলুমারুই পাড়া
এন বসু রোড
বর্ধমান।