শিল্পী পালিত ঃ করোনা লকডাউনের সময় খবরের ঘন্টার এই ওয়েবপোর্টালে আত্মকথা বিভাগের অনেক কিছু প্রকাশ করা যায়নি। আবার শুরু হলো আত্মকথা। লকডাউন প্রায় উঠে গেলেও এখন আনলক ওয়ান চলছে। আর কোভিড পজিটিভ আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাই আমাদের আরও বেশি বেশি করে সচেতন বা সাবধান থাকা জরুরি। আজ লেখক, শিক্ষক, কবি বিদ্যুৎ রাজগুরুর আত্মকথা মেলে ধরা হলো —
” আমি তখন ছোট্ট ছিলাম।বয়স কত আর হবে।মনে আছে যেটুকু খুব বায়না ধরতাম আমি ।যৌথ পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা।আমার অধিকাংশ বায়না সামলাত আমার মেজ জেঠূমা আরতি-আমি আরিমা বলে ডাকতাম।সাত সকালে হরেক রকমের চা দুধ ,দুধের সরসহ বেশ কিছু প্লেটবাটিতে সকালের চায়ের পরিপাটি ব্যবস্থা আরিমা করতেন।বাঁকুড়া জেলার বর্ধিষ্ণু দধিমুখা আমার গ্রাম।বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করতেন এবং মা বিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত একজন শিক্ষা কর্মী।মা ছিলেন সহজ সরল প্রাণ খোলা মানুষ। পর আপনের কোন গণ্ডি তাঁর কাছে কোন দিন ছিল না।অপরকে কিভাবে আপন করে নিতে হয় এমন গুণবতী নারী ছিলেন তিনি।মায়ের প্রশংসায় সকলেই পঞ্চমুখ।যার কোন শত্রু ছিল না।আমার মতো মা সকল সন্তানকে সমানভাবে ভালবাসতেন।এই ভালবাসার কোন ভাগ ছিল না।আর্থিক মানসিক সব দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া মানুষকে নিজেকে উজাড় করে সহযোগিতা করতেন।অবসর জীবনে মা ভয়াবহ ডিমেন্সিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলে সব কিছু স্মৃতিভ্রম হয়েছিল।আমাদেরও চিনতে পারতেন না।এমন কষ্টের মধ্যে তাঁর জীবনাবসান ঘটে।
বাবা বামপন্থী রাজনীতি নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন।কয়েক মাস পর হয়তো ঘরে ফিরতেন।কাজে মা কাকিমা জেঠুমারাই আমার ঝোঁক ঝুক্কি সামলাতেন।আমরা দুই ভাই কিন্তু একান্নবর্তী পরিবার হওয়ায় বাবাদের চার ভাইয়ের পরিবারের সকল ভাইবোন মিলে বাড়িটাকে ছোটখাটো পাড়ায় মনে হত।আমাদের বাঁকুড়ার দধিমুখা গ্রামটি শিক্ষা সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকা গ্রাম।তাই গ্রাম আজ আমাদের নয়নের মণি।প্রত্যেকে সকলের আত্মীয়।রাজনৈতিক বিভিন্ন মতাদর্শ থাকা সত্ত্বেও একতায় এই গ্রামের জুড়ি মেলা ভার।গ্রামের মানুষের ভালবাসার পাত্র ছিল মা নাম রেনুকা রাজগুরু-আবাল বৃদ্ধবনিতা মাকে রেনুমা বলে ডাকত।পরিবারসহ পাড়া পড়শির সকলের যেন মুশকিল আসান ছিল আমার মা রেনুমা।ছোট বেলার অনেক টুকরো কথা মনে পড়ে।আমাদের পরিবার কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিল।তাই চাষাবাদের সুযোগ ছিল।চাষের জন্য বলদ ও মহিষ পুষত ঘরে।আর ছিল গোয়াল ভরা গরু।যারা দুধ দিত।আমার ছোট কাকুর বেশ কিছু ছাগল ছিল।একটা সময় আমি ছাগল গরু নিয়ে কাটাতাম।গ্রামের শেষে জলাধারে মোষের পীঠে চড়ে ঘুরতাম।গরু মোষ চরাতাম বাড়ির এক রাখাল বালকের সঙ্গে।গরু মোষ নিয়ে কাটানোই যেন আমার নেশা হয়ে গিয়েছিল।প্রাথমিকে পড়াশোনায় এত মনযোগী হয়তো ছিলাম না।মাঠঘাট জমিজমা গরু ছাগল নিয়ে দিন কাটত।গ্রামীণ জীবন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছি।আর বাস্তব থেকে অনেক কিছু শিখেছি।
রাঢ় বাঁকুড়ার দধিমুখা হাই স্কুল থেকে মাধ্যামিক এবং দুর্গাপুর ফার্টিলাইজার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে উচ্চ মাধ্যামিক পাশ করে আমি সরাসরি চলে আসি শিলিগুড়ি।রেলওয়েতে কর্মরত বড় জেঠু উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের পুরানো বাসিন্দা।জেঠুর সূত্র ধরেই বাবা ও মেজ জেঠুর আলিপুরদুয়ারে পড়তে আসা।কাজেই উত্তরবঙ্গের সঙ্গে আমাদের নাড়ীর যোগ।এখানকার জলহাওয়ায় ভালোবাসায় আমাদের পরিবার মিলেমিসে একাকার।আমার দাদা সাহিত্যকর্মী ও রাজনৈতিক কর্মী পল্লবকান্তি রাজগুরু।তিনি শিলিগুড়ির শক্তিগড় বিদ্যাপীঠের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক।দাদা ও বড় জেঠুর সান্নিধ্যে শিলিগুড়ি অঞ্চলে আমার পরিচিতি চেনাজানা।আমাকে তাঁরা দার্জিলিং সরকারি কলেজে ভূগোল বিষয় নিয়ে ভর্তি করেন।তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি।আমার শিক্ষাগত জীবনী এরকম ছিল দধিমুখা নিম্ন বুনিয়াদি,দধিমুখা উচ্চ মাধ্যামিক বিদ্যালয়, দুর্গাপুর ফার্টিলাইজার উঃমাঃ বিদ্যালয় ,দার্জিলিং সরকারী কলেজ ,কানপুর বিশ্ব বিদ্যালয় ও লয়েলা কলেজ সিকিম – শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষাগত যোগত্যা অর্জন করি। সঙ্গে সঙ্গে চলে উত্তরবঙ্গ থেকে প্রকাশিত সংবাদ পত্র সংবাদ উত্তরবঙ্গ সংবাদ ,হিন্দি সংবাদ ভারত দর্পণ ও দৈনিক বসুমতী ,বীরপাড়া সংবাদ দাতা হিসাবে সাংবাদিকতার কাজ।বাঁকুড়ার দধিমুখা গ্রাম থেকে প্রকাশিত তৃষা পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক ছিলাম। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রেরনা হিসাবে কাজ করেছে জ্যাঠা মশাই প্রয়াত সুধীর কুমার রাজগুরু ,দাদা পল্লব কান্তি রাজগুরু।এবং বিশিষ্ট সাহিত্যিক শক্তিপদ রাজগুরু আমাদের পরিবারের গর্ব।জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়া কলেজে প্রথম ভূগোলের আংশিক সময়ের শিক্ষকতায় প্রথম যুক্ত হই। বর্তমানে শিলিগুড়ি মহকুমার নজরুল শতবার্ষিকী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে কর্মরত। আমি সাহিত্যকেও আন্দোলন হিসাবে দেখতে চাই – তাই আমার কবিতায় উঠে আসে প্রকৃতি, মানুষের পাশাপাশি প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কথামালা। কিছু কবিতা সঙ্গীতে রূপ পেয়েছে।আমার কবিতাগুলি স্থান পেয়েছে প্রকাশিত বিভিন্ন কাব্য সংকলন –“সপ্তর্ষির আলো ,অশ্বমেধের ঘোড়া,কাব্যকুহু ও কাব্যতীর্থ কাব্য সংকলনে।পরবর্তী কালে একক কাব্য সংকলন রয়েছে তাহল-সবুজের স্বরলিপি, নান্দী তিয়াসা, মনখারাপের দ্রাঘিমা পেরিয়ে,মনের সই এবং রয়েছে গদ্য সংকলন যেমন ‘উত্তরের বন্ধুরা’ও প্রকাশিতব্য ‘আলোর ঈশ্বর বিদ্যাসাগর’।বর্তমানে আনন্দবাজার, উত্তরবঙ্গ সংবাদ, আজকাল সহ একাধিক পত্রিকায় ফিচার ও কবিতা লেখালিখি চলছে।আমি চাই সুখি সুন্দর বিভেদহীন সম্প্রীতির সমাজব্যবস্থা।কবিতায় আমি বলি, কবিতা আমার মনের প্রিয়া /সৃষ্টি সুখের বৃষ্টি,/কবিতা আমার মন পবনের/ কবিতা আমার সৃষ্টি।/কবিতা আমার দিন বদলের/নতুন দিনের গান,/কবিতা আমার সূর্য সকাল/ রক্ত মেঘের টান।”
বিদ্যুৎ রাজগুরু