বাপি ঘোষঃ প্রাক বর্ষা সাইক্লোনিক ডিপ্রেশন বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়।আর সেই ডিপ্রেশন প্রয়োজন। কারন এর হাত ধরেই বর্ষা ভারতে প্রবেশ করে। কিন্তু এবারে সেই ডিপ্রেশন সুপার সাইক্লোনিক আম্ফানে পরিণত হয় যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের। আম্ফান নিয়ে জানাতে গিয়ে বৃহস্পতিবার খবরের ঘন্টাকে এমন ব্যাখ্যাই দিলেন উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ তথা ভুগোল বিশারদ ডঃ সুবীর সরকার। আম্ফান এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তিনি আরও অনেক কথাই জানালেন খবরের ঘন্টাকে। শুনুন তাঁর মুখ দিয়ে —
” আম্ফান একটি সাইক্লোন। বঙ্গোপসাগরে অনেক সাইক্লোন হয়। তারমধ্যে এই আম্ফান খুবই শক্তিশালী ছিলো। বছর বছরই একটা সাইক্লোন হয় বঙ্গোপসাগরে। কিন্তু সরাসরি সেসব কলকাতার দিকে আসে না। শেষে তা ঘুরে বাংলাদেশের দিকে চলে যায়। কিন্তু এবারে এই সুপার সাইক্লোন আম্ফান সরাসরি হলদিয়ার ওপর দিয়ে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ধাক্কা দিয়েছে। ফলে ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হয়েছে। তবে অপেক্ষাকৃতভাবে উত্তরবঙ্গে এর তেমন প্রভাব নেই, কিছু ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ছাড়া। এখন এই সুপার সাইক্লোন দুর্বল হয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় চলে গিয়েছে।
সাইক্লোন খুব একটা বিরল জিনিস নয়। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে। পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে সাইক্লোন সৃষ্টি হয় তারমধ্যে বঙ্গোপসাগর অন্যতম একটি অঞ্চল। এর পিছনে ভৌগোলিক কারনও রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের ভৌগোলিক অবস্থান এর পিছনে অন্যতম প্রধান কারন হিসাবে কাজ করছে। এর তিনদিকে স্থল, একদিকে জল। তাছাড়া বঙ্গোপসাগর অগভীর।ফলে ঝড় হলে জলোচ্ছ্বাস প্রবল হয় সেখানে। এর পাশাপাশি এর সঙ্গে যোগ হয় জোয়ার-ভাটা খেলা। অন্যদিকে আরব সাগর কিন্তু অনেক গভীর। তাই সেখানে সাইক্লোন এত শক্তিশালী হয় না।
এখানে দীঘার কথা ধরুন না। সেখানে মাইলের পর মাইল হাঁটু বা কোমড় সমান জল। ফলে তার প্রভাবও মারাত্মক হয়। আর একটি বিষয় হলো জনবসতি। সমুদ্রের ধারে কোস্ট লাইনে রাস্তাঘাট, বাড়ঘর তৈরি হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে ঝড় আটকানোর জন্য ঝাউবন, ম্যানগ্রোভজাতীয় বৃক্ষ বেশি দরকার। কিন্তু সেসব কমে গিয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে ঝড় আটকানোর রাস্তা কমিয়ে আমরা বিভিন্ন বাঁধ, মাটির বাঁধ দিয়ে ঝড় আটকানোর চেষ্টা করছি। আর সেসব বাঁধের বহু অংশ দুর্বল, নিয়মিত রক্ষনাবেক্ষনও হয় না। আর এতে ঝড় জলোচ্ছ্বাস হলে তা সহজে ভেঙে যায়। নোনা জল প্রবেশ করে চাষাবাদ নষ্ট করে দেয়। দীঘায় মার্বেল দিয়ে শক্ত যেসব বাঁধ আছে সেসব হয়তো ভাঙেনি। কিন্তু তার আশপাশেতো ভেঙেছে। তাই বলা যায় ঝড়ের জেরে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বৃদ্ধিতে মানুষের অবদান কিন্তু অনেকটাই দায়ী। আবার ঝড়ের গতিবেগও কিন্তু ধ্বংসাত্মক চেহারা বেশি করে আনছে। শহরের গাছপালা একটু দুর্বল। শহরের গাছগুলো মাটির ভেতরে খুব বেশি শিকড় বিস্তার করতে পারে না। ফলে সাধারণ ঝড়েও সেসব গাছ দ্রুত ভেঙে যায় বা উপড়ে পড়ে। কাজেই সুপার সাইক্লোন আম্ফান গাছপালা ভেঙে যে বেশি ক্ষয়ক্ষতি করবে এরমধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। যদিও এই করোনা দুর্যোগের সময় এরকম ক্ষয়ক্ষতি অত্যন্ত দুঃখজনক। এমনটা কখনোই কাম্য নয়।
এবারে বলা যাক গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। উত্তরবঙ্গ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে জলবায়ুর একটি বিবর্তন ঘটছে। এই বিবর্তনের একটি রুপ হলো, অনিয়মিত বা অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত। কখনও মাসের পর মাস বৃষ্টি নেই, আবার কখনো স্বল্পসময়ে একসঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টি কিন্তু কমেও যাচ্ছে না বা বেড়ে যাচ্ছে না। কিন্তু একটা অনিয়মিত বা অনিশ্চিত বৃষ্টিপাত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। একই সঙ্গে সাইক্লোন বা ঝড়বৃষ্টির প্রার্দুভাব বাড়ছে পৃথিবীর সর্বত্র। গত একশ দেড়শ বছরের পৃথিবীর বিভিন্ন রেকর্ড পর্যালোচনা করে বলতেই হচ্ছে, একটা জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে।
এবারে বলতে হয় বর্ষা আসার প্রসঙ্গে। এ মাসের শেষে একটা নিম্নচাপ ঘনীভূত হবে, এখন পর্যন্ত যা খবর। আর সেই নিম্নচাপ বর্ষা বা মনসুন আসার রাস্তা প্রশস্ত করবে। যদিও হিমালয় সংলগ্ন শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার ও সিকিমের আবহাওয়া আলাদা। জুলাই আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে কিন্তু গরম পড়ছে এবং পড়বে এই এলাকায়। কলকাতা সহ দক্ষিনবঙ্গে মার্চ এপ্রিল মেতে খুব গরম পড়লেও শিলিগুড়ি সংলগ্ন হিমালয়ে কিন্তু তা হয় না। এখানকার আবহাওয়ার আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে পাহাড় থাকায়। তবে এখনো পর্যন্ত যা খবর এবার মনসুন স্বাভাবিক নিয়মে আসবে। তবে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, প্রাক বর্ষা সাইক্লোনিক ডিপ্রেশন বঙ্গোপসাগরে তৈরি হয়। আর এই সাইক্লোনের হাত ধরেই বর্ষা আসে ভারতে। কিন্তু এবারে এই সাইক্লোনিক ডিপ্রেশন সুপার সাইক্লোন আম্ফানে পরিণত হয়েছে এটাই হলো দুর্ভাগ্যের। ”