বাপি ঘোষঃ করোনা মহামারী এবং লকডাউন শুধু অর্থনৈতিক নয়, এক সামাজিক বিপর্যয়ও তৈরি করছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে একটা ভাঙন এসে গিয়েছে। সেই ভেঙে যাওয়া ব্যবস্থাকে মেরামত করে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় চালাতে কতদিন সময় লাগবে তা এখনো বলা মুশকিল। তবে হিংসা ভুলে সব মানুষ যদি বেশি মানবিক হয়, যাদের আয় কম, তাদের কথা যদি শোনা হয় এবং ভাবা হয়, তবে হয়তো সামাজিক বিপর্যয়কে দ্রুত মেরামত করে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা সম্ভব। মানবিক ধর্ম বেশি করে পালন করতে হবে। করোনা ও লকডাউন বিপর্যয় নিয়ে এভাবেই খবরের ঘন্টার মুখোমুখি হয়ে ব্যাখা করলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় রায়। করোনা বিপর্যয়ের প্রেক্ষিতে সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তিনি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথাই জানিয়েছেন। চলুন সেসব পড়া যাক–
“এই করোনা বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা অনেকে অনেকভাবে করেছেন। আমি বলছি, যারা মধ্যবিত্ত, যারা পড়াশোনা বা লেখালেখি নিয়ে আছেন তাদের এই লকডাউনের সময় খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। বাজারঘাট যা খোলা আছে তাতে সমস্যা হচ্ছে না। উদ্বেগ বাড়ছে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে। কবে স্বাভাবিক পড়াশোনা শুরু হবে, ছাত্রছাত্রীদের কোর্স হয়তো ছয় মাস পিছিয়ে যাবে। এর পাশাপাশি যারা একটু বয়স্ক মানুষ, যাদের দীর্ঘদিনের কিছু অসুখ আছে বা আমাদের চেনাজানা মানুষ তাদের নিয়ে আমাদের চিন্তা বা উদ্বেগ রয়েছে।
আর একটু খুলে বললে বলা যায়, আমরা একদিকে যেমন স্বার্থপর মানুষ অন্যদিকে সমাজের কথাও ভাবি নিজেদের মতো করে। যদিও সবাই যে একেবারে রাস্তায় গিয়ে কাজ করছে তা কিন্তু নয়। তবে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের নিয়ে কিন্তু চিন্তা তৈরি হয়েছে। আমাদের সমাজে বেশিরভাগই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক।অধিকাংশ মানুষ দিনআনা দিন খাওয়া শ্রমিক বা মুটে মজুর। এইসব শ্রমিক মানুষদের কাজ বন্ধ এখন। এদের জীবনবাঁচা এখন হুমকির মধ্যে দাঁড়িয়ে। এদের ভবিষ্যৎ কি হবে, জানি না। কবে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটবে, কবে এইসব মানুষেরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে তা বলা যাচ্ছে না এখনই।
সরকার এদের জন্য চাল, ডাল, আটা বা খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। কিন্তু সেই খাবার সব নয়। সে খাবারের পরও তাদের ওষুধ কেনা, ডাক্তার দেখানো এসব বাবদ তাদের হাতে অতিরিক্ত কিছু টাকা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু তা এখন নেই। কাজেই এইসব হতদরিদ্র মানুষের কি হবে, সেটাই এখন উদ্বেগ।
আরও একটু খোলাখুলিভাবে বলতে গেলে বলা দরকার, পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং শ্রমিক শ্রেনীর মধ্যে একটা ভাঙন এসে গিয়েছে। আমাদের পুরো ব্যবস্থা চলে শ্রমিক শ্রেনীর পরিশ্রমের ওপর। সেই স্থানে যে ভাঙন তৈরি হয়েছে তা মেরামত করে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে কতদিন সময় লাগবে জানা নেই।
বিরাট জনমজুর শ্রমিক শ্রেনীর পাশাপাশি আবার কর্পোরেট সেক্টরে প্রচুর শ্রমিক কর্মচারী রয়েছে। সেই কর্পোরেট সেক্টরেও বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে। সেখানেও শুরু হয়েছে শ্রমিক কর্মচারী ছাঁটাই। এক গুরুতর অর্থনৈতিক সঙ্কট। ব্যবসা বানিজ্য ডাউন থাকায় বহু কর্পোরেট সেক্টর বা অন্য মধবিত্ত বেসরকারি চাকরিজীবিদের চাকরি ছাঁটাই হবে।ফলে এটাও এক বিরাট সমস্যা।
এসব খারাপ খবরের মধ্যে ভালো খবর হলো, যারা বই পড়তে চাইতেন, এতদিন সময়ের অভাবে বই পড়তে পারতেন না তারা এখন বই পড়তে পারছেন বেশি করে। অনেকে আর একটু বেশি করে ক্রিয়েটিভ বা লেখালেখি করতে পারছেন।দূষন কম হচ্ছে। জল ও বাতাস পরিস্কার হচ্ছে।
তবে এটা বলা যায় এই অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে হয়তো এক বছর পার হয়ে যাবে। ১৯৩০ সালে গ্রেট ইকনমিক ডিপ্রেশন তৈরি হয়েছিল। কিংবা ১৯৩৯ এবং ১৯৪৫ সালের বিশ্ব যুদ্ধের সময় যে অবস্থা তৈরি হয়েছিল। এবারে করোনার আগে ও পরবর্তী অবস্থা কিন্তু শুধু অর্থনৈতিক বিপর্যয় নয়, মানুষের চিন্তাভাবনা, জীবনযাত্রায় বড়সড় পরিবর্তন নিয়ে আসছে যা এক বিরাট ঐতিহাসিক ঘটনা।
আরও একটি বিশেষ দিক হলো, যখনই এরকম বিপর্যয় হয় তখন তার চটজলদি সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে কিছু কিছু সোস্যাল ডিজঅর্ডার আসে।এখন কি কি ডিজঅর্ডার হবে তা এখনই বলা মুশকিল।তবে কেও হয়তে আইন ভাঙতে পারে, কেও চুরি ছিনতাই রাহাজানিতে যুক্ত হতে পারে। আবার ডমেস্টিক ভায়োলেন্স বা নারী নির্যাতনও বাড়তে পারে।
এসবের প্রতিকারের উপায় এখনই বলে দেওয়াটা অবিবেচকের মতো হবে। তবে করোনার আগে আমাদের দেশে ধর্ম, নাগরিকত্ব নিয়ে যেসব ইস্যু ঘিরে হইচই হচ্ছিল সেসব ইস্যু এখন পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। মানুষকে এখন বেশি বেশি করে মানবিক হতে হবে। যার আয় কম তাদের কথা এখন বেশি বেশি করে শুনতে হবে। তাদের কথা বেশি বেশি করে ভাবতে হবে। আর তাহলে আমরা দ্রুত এই সামাজিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারবো। কিন্তু সেসব যদি আমরা না করি তবে বিপর্যয় আরও বাড়বে।
এখন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। আমি বলবো, ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স সবসময়ের জন্য হোক। অনেককে দেখা যাচ্ছিলো সাইকেল নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তায় থু থু ফেলছে। কেও বাড়ির ছাদ থেকে নীচে থু থু ফেলছেন। এসব কখনোই কাম্য নয়। বরঞ্চ এখন দূরত্ব মেনে লাইনে দাঁড়ানোর অভ্যাস আমাদের শৃঙ্খলাবোধ কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দিলে মঙ্গল। সামাজিক দূরত্ব আমাদের তৈরি হয় নি। তথ্য প্রযুক্তি নেট দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ বরঞ্চ মানুষের আরও দৃঢ় হয়েছে। এখন করোনা সতর্কতার জন্য যেটা দরকার তা হলো মুখে মাস্ক বেঁধে ফিজিক্যাল ডিসট্যান্স বজায় রাখা। ”