বাপি ঘোষঃ ভারতবর্ষে এখনও খানিকটা হলেও মূল্যবোধ বেঁচে রয়েছে। সে কারনে করোনা লকডাউনের পরও বিদেশের তুলনায় কম ক্ষতি হবে। খবরের ঘন্টার মুখোমুখি হয়ে এমনটাই অভিমত দিলেন উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট দার্শনিক ডঃ রঘুনাথ ঘোষ। ডঃ ঘোষ উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন শাস্ত্র বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। এখন তিনি ভারতীয় দার্শনিক অনুসন্ধান পরিষদের স্কলারশিপ নিয়ে বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে গবেষণার কাজ করছেন। তাঁর বাড়ি শিলিগুড়িতে হলেও এই লকডাউনের সময় আটকে পড়েছেন কলকাতায়। কলকাতা থেকেই তিনি খবরের ঘন্টাকে করোনা, লকডাউন নিয়ে অনেক কথাই জানালেন। তিনি ঠিক কি কি বললেন, আসুন তাঁর মুখ থেকেই পড়ে নেওয়া যাক–
“শিলিগুড়ি থেকে হায়দরাবাদে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম। লকডাউনের জেরে আটকে পড়েছি।দমদমের ফ্ল্যাটে আছি। এখানে মেয়ে থাকতো। এই লকডাউনের অবসরে লেখালেখি করছি। ঘরবন্দি থাকার জেরে মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে। কিন্তু উপায় নেই। এখানে কিছু বই আছে। সেসবও পড়ছি। তার পাশাপাশি লেখালেখি চলছে। দর্শন নিয়ে গবেষনার কাজ চলছে। ভারতীয় দার্শনিক অনুসন্ধান পরিষদের স্কলারশিপ নিয়ে বৌদ্ধ দর্শন নিয়ে গবেষণার কাজ করছি। সিকিম, নেপাল, ভুটানে বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষের বসবাস। তাদের ওপর কাজ হচ্ছে।
এখন এই করোনা লকডাউন নিয়ে যেটা বলবো, মানুষ যতই উন্নত বিজ্ঞান চেতনাসম্পন্ন হোক না কেন, আমাদের হাতে কিন্তু সব কিছু নেই। আমাদের দেশ গরিব দেশ। আর ইউরোপের দেশগুলো বেশ উন্নত। আজ এই করোনায় লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত। বহু মানুষ মারা যাচ্ছেন। ভারতবর্ষ কিন্তু সেদিক থেকে কিছুটা অন্য অবস্থানে। ভারতবর্ষে গরিব মানুষ বেশি। আর এখানে সহ্য করার ক্ষমতাও অনেক বেশি। ছোট বেলায় কবিতায় পড়েছিলাম, মন্বন্তর মরি নি, মারি নিয়ে ঘর করি। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরেও বেঁচে ছিলো বাঙালি, বেঁচে ছিলো ভারত। অতীতের মহামারীগুলোতও অনেক লোক বেঁচে ছিলেন। বিশ্ব যুদ্ধেও তত প্রভাব ছিলো না। ভারতের কিন্তু কষ্ট সহিষ্ণু হওয়ার ইম্যুনিটি পাওয়ার বেশ আছে। আজ শিলিগুড়ি হিলকার্ট রোডে কোনও বিদেশি বোতলের জল খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন কিন্তু আমাদের দেশে বহু মানুষ কলের জল খেয়ে বেঁচে আছেন ভালোভাবে। ভারতের মানুষের সহনশীলতা একটু আলাদারকম। তাছাড়া আত্মিক চেতনা, ঐক্যবদ্ধ থাকার মানসিকতাও ভারতের পুরনো বিষয়। এই যে আজ সবাই একসঙ্গে ঘরে থেকে লকডাউন পালনের মাধ্যমে করোনা বিরোধী যুদ্ধ করছে, তা কিন্তু একাত্ম হওয়ার কথা বলে। আমাদের ভারতীয় দর্শন বহুদিন ধরে একাত্ম হওয়ার কথা বলে আসছে।মানুষে মানুষে আজ সামাজিক দূরত্ব থাকলেও রিদয়ের দূরত্ব কিন্তু কাম্য নয়। আজ ঘরবন্দি থেকে আমরা সবাই সামাজিক দূরত্ব মেনে ছললেও লকডাউন উঠলেই আবার সবাই বাড়ির বাইরে বেরিয়ে রিদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবো। আধ্যাত্মিকতার আত্মিক শান্তি আছে এদেশে। এখনও আমাদের দেশের মানুষ অতটা জড়বাদী হয়ে ওঠেননি। হতে পারে এখন আমাদের দেশে বহু লোক খেতে পারছেন না, কিন্তু তাঁরা লকডাউন মেনে চলছেন। অথচ ইউরোপ বা বিদেশের অনেক দেশে লকডাউন খোলার জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করছে, আন্দোলন করছে। ওরা দেরিতে লকডাউন শুরু করেছে আর আর্থিক দিক চিন্তা করে লকডাউন তাড়াতাড়ি খুলেও দিতে চাইছে। আর ভারতের আর্থিক দিক ওদের মতো মজবুত না হলেও ভারতের সরকার মানুষের জীবন-প্রানের কথা বেশি করে চিন্তা করছে। এই ভারতের একজন দার্শনিক হিসাবে আমি তাই গর্ববোধ করি। ভারতবর্ষের দর্শনে এই যে সহনশীলতা, ত্যাগ, তিতিক্ষা, গৌতম বুদ্ধের অহিংস বানী কিন্তু তাই এসময় আবারও স্মরন করতে হচ্ছে। ভারতে এখনও মূল্যবোধ আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আমি ঘুরেছি। বিদেশীদের সততা আছে। কিন্তু ভারতের মতো এরকম মূল্যবোধ ওদের নেই। ভারতে আসা কোনও বিদেশীর রক্তের প্রয়োজন হলে ভারতীয়রা রক্তদান করে তাঁর প্রান বাঁচাবে, কিন্তু বিদেশে তেমনভাবে এ বিষয়টি নেই। ভারতবর্ষের মূল্যবোধ এখনও খানিকটা হলেও টিকে আছে, সেই কারনেই আমি বলবো, করোনা লকডাউন আমাদের সেভাবে ক্ষতি করতে পারবে না।
এবারে বলি প্রকৃতি পরিবেশের কথা। আমাদের দর্শনেও প্রকৃতির কথা বারবার গুরুত্ব দিয়ে বলা হয়েছে। আমি ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা একটু বলতে চাই। সেই বন্যায় আমি খিদিরপুরে তিন দিন না খেয়ে ছিলাম। তখন কলেজে পড়ছি। সে বন্যায় রেল লাইননগুলো সব সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়েছিল। মানুষ আর সাপকে একসঙ্গে গাছের মধ্যে ছিলো। বহু রেল লাইন কোথায় যে উড়ে গিয়েছিল তার আর হদিশই মেলেনি। সেই ঘটনা স্মরন করে আজ করোনা দুর্যোগএর সময়ও কিন্তু বলবো, প্রকৃতিকে কিন্তু আমাদের এবার আর একটু বেশি করে যত্ন নিতে হবে। প্রকৃতিকে অনাদর করা যাবে না। আমরা গাছ কাটছি, দূষন সৃষ্টি করছি। প্রকৃতি না থাকলে যে আমরা কেও বাঁচবো না তা কিন্তু অনেকে বুঝতে চাইছি না। প্রকৃতি ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকবো। দক্ষিন ভারতে সংস্কৃত ভাষায় একটি লেখা দেখেছিলাম অনেক দিন আগে। বৃক্সো রক্সোতো রক্সতি। অর্থাৎ গাছকে রক্ষা করলে সেও আমাদের রক্ষা করবে। গাছের সঙ্গে আমাদের পরস্পর ভালোবাসা, বোঝাপড়ার সুসম্পর্ক না থাকলে আমরা ভালো থাকতে পারি না। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও বলে গিয়েছেন, সাহিত্য প্রবন্ধের জন্য সাহিত্যের কোনও মানে হয় না, বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে যে সাহিত্য সেটাই প্রকৃত সাহিত্য।
আজ আমরা এইডস ভাইরাসের নামও শুনছি। সুনামি, ভূমিকম্পও হচ্ছে। করোনা মহামারীতো আমাদের সময় দিচ্ছে, ঘরে বসে একাত্ম হয়ে লড়াই করার। হঠাৎ বিরাট ভূমিকম্প বা সুনামি হলে কি আমাদের এভাবে সময় দিতো? ”