বাপি ঘোষঃ আজ করোনা মহামারী দুর্যোগ নিয়ে আমরা সবাই লড়াই করছি। কিন্তু অতীতেও মহামারী এসেছে আমাদের দেশে। শিলিগুড়ি সুকান্ত নগরের বাসিন্দা তথা কোচবিহার রাজবাড়ির অবসরপ্রাপ্ত কর্মী জগদীশ সরকার আজ থেকে ৭৯ বছর আগে এক রাতের মধ্যে কলেরা মহামারীতে হারিয়েছিলেন তাঁর বাবা ও দুই দাদাকে।কেমন পরিবেশ হোত সেই সময় স্মৃতিচারনায় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব জগদীশ সরকার। পড়ুন নিচের অংশ থেকে–
” আমি জগদীশ সরকার। এখন বাড়ি শিলিগুড়ি সুকান্ত নগরে। বয়স ৯৬ বছর। শুরু হয়েছে করোনা দুর্যোগ। সবাই আমরা ঘর বন্দি। ঘর বন্দি অবস্থা থেকেই খবরের ঘন্টার কাছে কলেরা মহামারীর বেদনাদায়ক স্মৃতি রোমন্থন করছি।
করোনার মতো এরকম দুর্যোগ অতীতে দেখিনি। তবে ১৯৪১ সালে কলেরা মহামারীর কথা জানি। নিজে চোখে দেখেওছি। তখন আমার বয়স আনুমানিক পনেরষোলো হবে। আমি থাকতাম কোচবিহার ব্যাঙচাতরা রোডে। সেখানেই আমাদের বাড়ি ছিলো। আমার বাবার নাম ছিলো স্বর্গীয় যাদব চন্দ্র সরকার। আর আমার দুই দাদা স্বর্গীয় রমেশ চন্দ্র সরকার এবং কনক সরকার। এক রাতের মধ্যে কলেরায় মারা গেলেন আমার বাবা, দুই দাদা। তখন গ্রামগুলো হয়ে যেতো নিস্তব্ধ। গ্রামে কলেরা দেখা দিতেই যে যার মতো অন্য গ্রামে পালিয়ে যেতো। অথবা কেও বাড়ি থেকে বের হতেন না। কলেরার সঙ্গে তখন ম্যালেরিয়াও হোত। ১৯৩৬ সালে কোচবিহারে খুব ম্যালেরিয়া হয়েছিল। ম্যালেরিয়া জ্বরে পেট হয়ে যেতো উঁচু আর গলা হোত সরু।
কলেরার ভয়ে কেও কারও সঙ্গে দেখা করতো না। সে এক ভয়ানক অবস্থা। গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে যেতো কলেরায়।
১৯৪৩ সালে আমি কোচবিহার রাজবাড়িতে রেকর্ড কীপার হিসাবে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। মহারাজা ছিলেন জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুর। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত রাজবাড়িতে কাজ করেছি। মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুর ১৯৭০ সালে প্রয়াত হন। মহারাজার কোনও সন্তান ছিলো না। তাই মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুরের ভাইয়ের ছেলে বীরাজেন্দ্র নারায়ন রাজ পদে বসেন। আমি ১৯৭১ সালে রাজবাড়ির কাজ থেকে অবসরগ্রহণ করি। রাজবাড়িতে কাজ করার সময় মনে আছে ১৯৬৮ সালে জলপাইগুড়ির ভয়াবহ বন্যার কথা। সেবারে আমি মহারাজার আদেশে বিশেষ বিমানে একা একটি বিমানে কলকাতায় গিয়েছিলাম। মনে আছে, ১৯৬২ সালের কথা। সেবারে চিন ভারতকে আক্রমণ করেছিলো। সেই সময় ভারত সরকার সকলের কাছে ত্রান চায় দুর্যোগ কাটাতে। মনে আছে, ভারতের ওপর চিনের আক্রমনের পর কোচবিহার মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুর কোচবিহারে বিশেষ মিটিং করেছিলেন। মহারাজা কোচবিহারের প্রজাসাধারনের কাছ থেকে ত্রান যেমন টাকাপয়সা, সোনাগহনা সংগ্রহ করেছিলেন। তারপর সেই সব ত্রান এবং মহারাজার বহু অর্থ মহারাজা ভারত সরকারকে ত্রান হিসাবে দিয়ে ভারত সরকারের হাত শক্ত করেছিলেন।
আজ এই করোনা দুর্যোগ এর সময়ও ভারতবাসীকে সেই রকম ত্রান, সেবায় একসঙ্গে নামা উচিত বলে মনে হয়। তবে মনে প্রশ্ন জাগে, আজকের বিজ্ঞান লিঙ্গ পরিবর্তন করছে, আজকের বিজ্ঞান কি উন্নতি করেছে অথচ দ্রুত করোনা ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারছে না?
তবে আজকের নতুন প্রজন্ম কিন্তু অনেক কিছু জানে। কদিন আগে একটি তথ্য খুঁজে পাচ্ছিলাম না, একটি ছোট ছেলে মোবাইলে গিয়ে গুগলে গিয়ে সব বের করে দিলো। বেশ ভালো লাগলো। এইসব নতুন ছেলেমেয়েরা অনেক কিছু জানে। এদের থেকেও আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। আমার বিশ্বাস এই ছেলেমেয়েরা নিশ্চয়ই কিছু আলো আনবে।
সবাই ভালো থাক। আমাদেরতো চলে যাওয়ার সময় এখন। পৃথিবী করোনা মুক্ত হোক। ঘর বন্দি থেকেই সবাই লড়াই করুক নতুন ভোরের আশায়। ”