শিল্পী পালিত ঃ করোনার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে যুদ্ধ। শুরু হয়েছে লকডাউন। কিন্তু ঘরবন্দি অবস্থায় মানুষ কিভাবে সময় কাটাবে। তাই খবরের ঘন্টার সম্পাদক বাপি ঘোষ সকলের কাছে সৃজনমূলক বিভিন্ন কাজ যেমন অনু গল্প, কবিতা, অঙ্কন, সঙ্গীত প্রভৃতির চর্চা করার আবেদন জানান। অনেকেই তাদের সৃজন কাজ পাঠানো শুরু করেছেন। খবরের ঘন্টার ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে তা পোস্টও হচ্ছে। এই ওয়েবপোর্টালে বুধবার একটি গল্প পোস্ট হয়েছে। আজ কলকাতা থেকে পাঠানো চন্দ্রানী সাধুখাঁ(বিশ্বাসের)র লেখা গল্প পোস্ট হলো। ধন্যবাদ চন্দ্রানীদেবীকে। সবাই খবরের ঘন্টার সঙ্গে থাকুন।গল্পের নাম বন্ধ জানালাটা।
বন্ধ জানালাটা
বহু কসরৎ করেও জানালাটা খুলতে পারলো না পিহু। বহুদিন খোলা না হওয়ায় একেবারে আটকে গেছে। রবারগুলোও রোদের তাপে গলে গিয়ে যেন কামড়ে ধরে আছে জানালাটাকে। আরও কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছাড়লো পিহু।
আর যে কারনে জানলাটা খুলতে চাওয়া, সেই গরমটাও যেন পিহুকে আঁকড়ে ধরলো আরও।
জানালার কাচ দিয়ে বাগানের গাছগুলো দেখা যাচ্ছিল। কেমন যেন থমকে জড়সড় হয়ে আছে। চারিদিকে ছড়িয়ে থাকা এই “করোনা ” আতঙ্ক কি ওদেরও ছুঁয়ে গেছে?
আকাশটাও ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। রাতের অন্ধকারে মাটির উপরের আবছায়া কালো কালো গাছপালার অবয়ব আর আকাশের কালোর নকশা যেন পিহুকে বহু পিছনে ফেলে আসা দিনগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
ঠিক কত বছর খোলা হয় নি এই জানালাটা মনে করার চেষ্টা করছিল ও। পাঁচ, ছয়, সাত … হ্যাঁ তার চাকরিটা তো সাতবছরই পূর্ন করলো জানুয়ারিতে।
নিজেই অবাক হল। সত্যিই সাত সাতটা বছর খোলা হয় নি জানালাটা?
অঙ্কের হিসেবেও তো তাই বলছে। জানুয়ারিতে চাকরি প্রাপ্তি। শীতের কারনে জানলা খোলার বালাই ছিল না তখন।
শীত কমলেও ও জানালা খোলা হত না। কুনালের অফিস, বুবলুর স্কুল আর নিজের অফিস যাওয়ার তাড়ায় সকালটা যে কখন পালিয়ে যায় তা তো গত সপ্তাহেও তো টের পেত না পিহু।
তাছাড়া সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। তাই বৃষ্টি এলে জানালাটা বন্ধ করার কেউ নেই। শাশুড়ি মা তো হাঁটুর ব্যথায় উপরে আসতেই পারেন না।
জানালাটা যেহেতু বিছানা লাগোয়া তাই বিছানা ভিজে যাওয়ার ভয়েই জানালাটা বন্ধ করেই অফিস যায় পিহু।
আবার অফিস থেকে ফেরার পর ফুলস্পীডে ফ্যান ঘোরে। গরম বাড়লে এসি। জানালাটা তাই একেবারেই অকেজো হয়ে গিয়েছিল পিহুর জীবনে।
অথচ এই বিছানার গায়ে লেগে থাকা জানালাটা একসময় ছিল পিহুর কল্পনা বিলাসের জায়গা। দোতলার এই দখিনখোলা ঘরটার জানালা তখন খোলাই থাকতো। বিয়ের পর পর এই জানালা দিয়েই বাগান থেকে বেল, জুঁই আর হাস্নুহানার গন্ধ ভেসে আসতো। পিহু হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে গান গাইতে বসতো। মনের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ জেগে ওঠা শব্দগুলোকে নিয়ে এলোমেলো কবিতা লিখে ডায়েরী ভর্তি করতো।
বিছানায় শুয়ে চাঁদের আলো দেখতে পেত। পূর্নিমার রাতে সে আলো বিছানায় লুটোপুটি খেতে খেতে এক হয়ে যেত নববধূ পিহুর লজ্জা শিহরন আর কুনালের দুষ্টুমির সাথে।
তারপর বুবলু এলো। বুবলু আসার পরও জানালাটা খোলা ছিল।
“আয় আয় চাঁদমামা ” গেয়ে যখন বুবলুকে ঘুম পাড়াতো পিহু তখনও ওই জানালা দিয়েই চাঁদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করতো, কে বেশি সুন্দর! অবশ্য প্রতিবার বুবলুই জিতে যেত।
তারপর যেদিন কুনালের অ্যাকসিডেন্টটা ঘটলো, সেদিনও তো জানালা খোলাই ছিল। সারারাত জানালার পাশে স্তব্ধ পাথরের মত বসেছিল পিহু।
স্কুল পেরিয়ে পাঁচ কিলোমিটার দূরে এক জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল।
সেদিন স্কুল যাবে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েও স্কুলে যায় নি কুনাল। সহকর্মী তনুজাকে নিয়ে চলে গিয়েছিল পাঁচ কিলোমিটার দূরের শহরটাতে। সারাদিন ঘোরাঘুরি, শপিং করে ফেরার পথে ট্রাকের ঠোক্করে দুজনেই আহত হয়। কুনালের পা ভেঙেছিল আর তনুজার মাথা ফেটেছিল। মারাত্মক কিছু নয়। তবু যেন অনেক বড় আঘাত। হৈ চৈ, লোক জানাজানি, সোশ্যাল মিডিয়া -ছয়লাপ হয়েছিল রসালো গল্পে।
এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল পিহু আর কুনালের সম্পর্কটাও।
সেরাতে কুনালও জেগেছিল। কিন্তু পিহুর স্তব্ধ মূর্তি দেখে যন্ত্রনার কাতরোক্তিগুলো ও চেপে রাখতে চেষ্টা করছিল। আর বিশ্বাস ভাঙার যন্ত্রনায় পিহুর বুকের মাটি ভিজছিল কান্নাবৃষ্টিতে।
সেও তো প্রায় বছর আষ্টেক হয়ে গেল। বুবলু তখন মাস ছয়েকের।
তারপর পিহু যেদিন এই প্রাইভেট কোম্পানির চাকরিটায় যোগ দিল সেদিন খোলা জানালাটার গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল অনেকক্ষণ। মনে মনে অদৃশ্য কারোকে যেন কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল।
সে বছরই গরম পড়তেই সব জানালাগুলো রবার প্যাডিং দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হল। এ বাড়ির অন্য অন্য জানালাগুলোরও ওই একই দশা হল। জানালায় দামী ভারী পর্দা ঝুললো। যাতে রোদ বা তাপ ঘরে ঢুকতে না পারে। ঘরটার ভোল বদলালো অনেকটাই। সুন্দর সাজানো ঘরে দুটো মানুষ পুতুল বাস করতে লাগলো।
সেই সময় থেকেই বুবলুও রাতে ঠাম্মার কাছে শোওয়া শুরু করলো।
আর পিহু কুনালের ছয় সাত মাপের মেহগনি কাঠের খাটটাতে শুয়ে থাকা দুজনের মাঝে রয়ে গেল একটা খাঁ খাঁ করা শূন্যতা ।
তনুজার সাথে কুনালের সম্পর্কটা শেষ হয়ে গিয়েছিল অ্যাকসিডেন্টের পরেই। কিন্তু পিহু আর ফিরতে পারে নি। ও কুনালের গায়ে যেন অন্য মেয়ের গন্ধ পেত।
এখন প্রতি রাতে দুজন দুদিকে মুখ ফিরিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়ায়। তবে পিহুর বিচরন নির্দিষ্ট।
ইমনের সাথে পরিচয় ফেসবুকেই। সাতটা বছর বয়ে গেছে। বন্ধুত্ব পেরিয়ে সম্পর্কটা এখন গভীরেই। ইমনও বিবাহিত। এক সন্তানের পিতা। বিবাহিত জীবনে সুখী নয় বলেই আক্ষেপ প্রকাশ করে। আর এই আক্ষেপটাই পিহুকে দূর্বল করে দিয়েছিল। যদিও পিহু এখন জানে, দোষটা ইমনেরই।
তবু পিহুর দিন কেটে যাচ্ছে এক মরীচিকার সন্ধানেই।
অবশ্য আজকাল কখনও কখনও পিহুর বুকটা যেন হু হু করে ওঠে। ইমন যে একটুও বদলায় নি বুঝতে পারে।
ইমনের জীবনে যে একনিষ্ঠতার মূল্য কোনোদিনই ছিল না, তাও ক্রমশঃ টের পেয়েছে পিহু। ইমনের দাম্পত্য কলহের কারনও ইমনের পল্লবগ্রাহিতাই।
আজকাল কখনও কখনও সারারাতও ইমনের নামের পাশে সবুজ আলোর বিন্দুটা জ্বলতে দেখে পিহু। অথচ সে সব রাতে পিহুর সাথে ইমনের কথা তো দূর, পিহুর মেসেজ দেখারও সময় হয় না। পরের দিন প্রশ্ন করলে বলে, ঘুমিয়ে পড়েছিল।
আরও পরে জানাজানি হয় গল্পটা অন্য ছিল।পিহু কষ্ট পায়, তবু ইমনের মধ্যে কি যেন একটা আছে অসংখ্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে জেনেও পিহু সরে যেতে পারে না। তাই কষ্টটা বয়েই বেড়ায়।
তারপর এখন তো এই সাত সাতটা দিন কোনো কথাই হয় না। বহুবার ফোন করার পর ফোন ধরে বলে, এখন বাড়িতে, কথা বলা সম্ভব নয়। অথচ মেসেঞ্জার বা হোয়াটস্ অ্যাপে ইমনের নামের পাশে সবুজ বাতি জ্বলতেই থাকে। বাতি জ্বলে ছন্দবানীর নামের পাশেও। পিহু সব জেনে এখন চুপই থাকে।
গত সাতটা দিন ধরে পিহুও বাড়িতে। কুনালও। বুবলুরও স্কুল ছুটি। আপাতত ১৪তারিখ পর্যন্ত লকডাউন। রান্নামাসীকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে পিহু। ঘর মোছা বাসনমাজার কমলাদিদিকেও। নিজেই রান্না ঘরের কাজ করছিল প্রথম দুদিন। দীর্ঘদিনের অনভ্যাস। কাজ সারতে সারতে জলখাবার বেলাটাও পেরিয়ে যাচ্ছিল।
তৃতীয় দিন কুনাল এগিয়ে আসে। জোর করেই হাত থেকে কেড়ে নিল ছুরি আর চপিং বোর্ডটা। একটা একটা করে সবজী কেটে ধুয়ে দিল। সেদিন রাতে ঘরে পাতা টক দই দিয়ে দারুন টেস্টি একটা রায়তা বানিয়ে ফেললো কুনাল। পিহু যে রায়তা খেতে ভালোবাসে সেটা সে নিজেই ভুলে গিয়েছিল।
এখন প্রতিদিন ওয়াসিং মেশিনের কাজটা কুনালই করছে। সবজীটা ওই কেটে দেয়। খাবার টেবিলে বসে চীন ইতালি আর ভারতের করোনা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠে দুজনেই। হাতের এঁটো হাতেই শুকিয়ে যায়।
গতকাল তো কিভাবে যেন কিছুটা চিকেন আর ছোট্ট ছোট্ট পুকুরের চিংড়ি মাছ ম্যানেজ করে আনলো কুনাল। পিহু এই চিংড়িগুলো খেতে ভীষণ ভালোবাসে।
এমনিতে অকারনে বাইরে বেরোনোর সরকারি নিষেধাজ্ঞা আছে। তবু সবজী কেনার তাগিদেই বেরিয়েছিল কুনাল। যতক্ষণ ও বাইরে ছিল পিহু কাজে মন দিতে পারছিল না। পুলিশের টহলদারি গাড়িগুলো দেখে চমকে উঠছিল।
কুনাল যখন ফিরলো, তার একমুখ হাসি দেখে পিহুর বুকটা কেমন যেন টনটন করে উঠলো। খুব রোগা হয়ে গেছে কুনাল।
চিকেনটা কুনালই রাঁধলো। বহুদিন পর। দুপুরে ঘরে এসে পিহু দেখে হোয়াটস্ অ্যাপে একগাদা মেসেজ। তবে কি ইমন?
না! কুনাল একগাদা বিখ্যাত উপন্যাসের পিডিএফ পাঠিয়েছে। সাথে একটা ছোট্ট মেসেজ। একটা বইমুখো পাগলীর সময় কাটানোর জন্য …!
চোখটা ভিজে গেল। পিহুর এত ছোটখাটো পছন্দগুলোও কুনালের মনে আছে?
অথচ সারাদিন অনলাইন থেকেও চারদিন আগে পাঠানো মেসেজগুলোর একটাও দেখে নি ইমন। আশ্চর্য লাগে ছন্দবানী আর ইমনের অফ অনের সময়টা অদ্ভুতভাবে মিলে যায়! গল্পটা এখন পড়তে পারে পিহু।
ভাবতে ভাবতেই জানালাটা ঠেলাঠেলি করছিল পিহু। ঘড়িতে রাত পৌনে তিনটে। কখন কারেন্ট অফ হয়েছে কে জানে। ইনভার্টারও অফ হয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে দমবন্ধ করা গুমোট। তার ফলেই ঘুম ভেঙেছে পিহুর। কিন্তু এখন এই জানালাটা যদি খুলতে পারতো তাহলেও হয়তো বাকি রাতটা ঘুমোতে পারতো।
“সরো আমি দেখি ” কুনালের গলার আওয়াজে ফিরে তাকায় পিহু।
জানালাটা খোলার চেষ্টা করছিল কুনালও।
কিন্তু কুনালও গলদঘর্ম হয়ে উঠছিল। শেষে বললো, “এককাজ করো তো, তুমি বারান্দায় যাও। ওদিক থেকে তুমি টানো আর আমি এদিক থেকে ঠেলি। তাহলে হয়তো খুলবে। একার দ্বারা এ জানলা খোলার নয়। ”
কথাটার মধ্যে কি ছিল কে জানে! দুজনেই যেন একটু চমকে উঠলো। একপলকের জন্য কুনালের চোখে চোখ রাখলো পিহু। কুনালের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠছিল একটা আলতো ঝিকমিক হাসি। বিয়ের পরের দিনগুলোতে এই হাসিটাই কুনালের সারা মুখে ছড়িয়ে থাকতো। মনে পড়তে পিহুও হেসে চোখ নামালো।
আশ্চর্য ব্যাপার! এতক্ষণ চেষ্টা করেও যে জানালাটা খোলা যায় নি। সেই জানালাটাই খুলে গেল ম্যাজিকের মত।
গ্রীলের ফাঁক দিকে পিহুর হাতটা ধরে কুনাল আলতো চাপ দিয়ে বললো, “ভোর হয়ে এসেছে কিন্তু! ”
ঠিক তখনই যেন ঝাঁপিয়ে পড়লো থমকে থাকা ঝড়টা। কুনাল বেরিয়ে আসে বারান্দায়। ওদের আলিঙ্গনাবদ্ধ শরীরদুটো ঘিরে ঝড়বৃষ্টির উল্লাস যেন এক অন্য ভোরের সূচনা করছিল। কুনালের বুকে মুখ গুঁজে হু হু করে কেঁদে উঠলো পিহু। কি যেন বলতে গেল। তার আগেই পিহুর মুখে হাত চাপা দিয়ে কুনাল বলে উঠলো, “আমি সব জানি, সব! ”
ভোরের আধফোটা আলোয় ওরা একে অপরকে ফিরে পাচ্ছিল। মুষলধারার বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছিল সব অভিমান। দুজনেই বোধহয় ভাবছিল, “ভাগ্যিস লকডাউনটা হয়েছিল। ” (শেষ)