বাপি ঘোষ ঃ ইতিহাসের পাতায় চোখ মেললে আমরা কুখ্যাত দস্যু বা ডাকাত রত্নাকর কিভাবে মহাকবি বাল্মিকী মুনি হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন তার এক দৃষ্টান্তমূলক গল্প জানতে পারি।রামায়ণের মতো মহাকাব্যের রচয়িতা হিসাবে আমরা চিনি বাল্মিকী মুনিকে। অর্থাৎ একজন খারাপ মানুষও শ্রেষ্ঠ প্রতিভাধর হয়ে উঠতে পারেন।আজকের এই প্রতিবেদনটি শুরু হলো ধারাবাহিকভাবে।স্কিপ না করে সবটা দেখতে থাকুন। রোমহষর্ক কিন্তু শিক্ষামূলক অনেক ইতিবাচক ভাবনার বার্তা পাবেন এই খবর থেকে।একেবারে সিনেমার মতো এক বাস্তব ঘটনা যা ভাবা যায় না। তবে মূল খবরে যাওয়ার আগে খবরের বিষয় সংক্রান্ত কারণে আমরা মা সারদামনির কিছু বাণী স্মরণ করছি। মা সারদা বলে গিয়েছেন,” আমি সতের-ও মা, অসতের-ও মা।আমি সত্যিকারের মা, গুরুপত্নী নয়,পাতানো মা নয়,কথার কথা মা নয়–সত্য জননী। ” আবারও মা সারদাই বলেছেন,” যদি শান্তি চাও মা কারও দোষ দেখো না।দোষ দেখবে নিজের।জগৎকে আপনার করে নিতে শেখ। কেউ পর নয়,মা জগৎ তোমার। ” মা সারদা আরও বলেছেন,”ভাঙতে সবাই পারে, গড়তে পারে ক’জনে? নিন্দা ঠাট্টা করতে পারে সব্বাই, কিন্তু কী করে যে তাকে ভালো করতে হবে, বলতে পারে কজনে”। মা সারদামনিদেবী বলেছেন,”দয়া যাঁর শরীরে নাই, সে কি মানুষ? সে তো পশু।আমি কখনও কখনও দয়ায় আত্মহারা হয়ে যাই,ভুলে যাই যে আমি কে?”। দেবী মা সারদা বলেছেন, “একশোজনকে খাওয়াতে হবে না,কিন্তু চোখের সামনে একজন ক্ষুধার্তকে দেখলে তাকে একটু খেতে দিও। ”
হ্যাঁ,এবারে মূল খবরে যাওয়া যাক।আজ থেকে ৩৫ বছর আগের ঘটনা, ১৯৮৮ সাল। শিলিগুড়ি শক্তিগড়ের এক ১৪ বছরের কিশোরীর পেটে অসম্ভব খিদে। তাঁর বাবা সদ্য প্রয়াত হয়েছে।মা চলে গিয়েছে বাইরে। একদিকে পেটে খিদের জ্বালা,আরেকদিকে মনে খুব দুঃখ। সে হেঁটে চলেছে শিলিগুড়ি মহকুমার পানিট্যাঙ্কি নেপাল সীমান্ত লাগোয়া মেচি নদীর পাশে এক চা বাগান ও জঙ্গল ভরা আদিবাসী গ্রাম দিয়ে।সেই কিশোরীর চোখে জল, হাঁটতে হাঁটতে সে কিশোরী ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো একটি মহিলাদের জটলার স্থানে। সেখানে তখন কয়েকজন মহিলা মুড়ি চিড়া গুড় খেয়ে চলেছেন। সেই মহিলারা ওই কিশোরীকে কান্নাকাটি করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কাঁদছো কেন? তোমার কি হয়েছে?” কিশোরী জানালো,” আমার খুব খিদে পেয়েছে।” তখন মহিলারা তাকে কিছু মুড়ি চিড়া গুড় খেতে দিলেন । কিশোরী সেই চিড়ামুড়িগুড়কে অমৃতের মতো খাবার ভেবে খেতে শুরু করলো।কিন্তু তারপরও কিশোরীর মনে দুঃখ যায় না। তখন সেই মহিলাদের মধ্যে একজন সে কিশোরীকে জিজ্ঞেস করলেন ” তোমার আর কি দুঃখ?” কিশোরী জানালো,” আমার একটি কাজ চাই। ” সেই মহিলা জানালো -” চলো, তুমি আমার বাড়িতে কাজ করবে। ” কিশোরী তখন সেই মহিলার হাত ধরে তার বাড়ি গেল।সে মহিলা তাকে বাসন মাজতে দিল। বাসন মাজতে গিয়ে কিশোরীর চোখে অঝোরে জল চলে এলো।সে কান্না থামে না, তার মনে পড়ে যায় তার প্রয়াত বাবার কথা। সে ভাবতে থাকে, বাবা বেঁচে থাকলে এই দুঃখ হতো না। বাবা বেঁচে থাকলে কত সুখে থাকতাম, কারণ বাবার সংসারে কখনোই বাসন মাজতে হয়নি। কিশোরীর মনে পড়ে, ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত মন দিয়ে পড়াশুনার পর হঠাৎ পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হয়েছে।পড়াশোনা করতে ভালোই লাগতো। অথচ বড় হয়ে আইপিএস অফিসার হওয়ার ইচ্ছে ছিলো তার। ভাবতে ভাবতেই চোখে কান্না আর জল। এবারে সেই বাড়ির মালকিন কিশোরীকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,” তুমি কাদছো কেন?” কিশোরী তখন সত্যিটা বলেই দিল,” আমি তো কোনোদিন বাসন মাজি নি। এ কাজ আমি করিনি। “সে মহিলা তখন কিশোরীকে জানালো, তোমায় আর বাসন মাজতে হবে না, চলো কাল থেকে তোমায় অন্য কাজ দিচ্ছি । পরের দিন সে কিশোরীকে সেই মহিলা নিয়ে গেল নেপালের কাকরভিটায়। সেখানে দুই বস্তা দুই কেজি ওজনের সুপারি দিয়ে মহিলা বললেন,” এই সুপারির বস্তা দুটি তুমি মেচি নদী পার করে ভারতে নিয়ে যাও।” সীমান্ত দিয়ে এভাবে সুপারি পাচার করা অন্যায়, বেআইনি কাজ সে কিশোরী তখন তা জানতো না । তার তো পেটে অভাব, কাজ করে কিছু খেতে হবে। সে নিজের অজান্তেই মাথায় করে সেই সুপারির বস্তা দুটি মেচি নদী পার করতে যাচ্ছিল, হঠাৎ নদীর স্রোতে সে ভেসে যায়। চলে আসে ভারত সীমান্তে,সুপারির বস্তা দুটি সে হাতছাড়া করে নি। তখন তাকে আটক করেন এস এস বি জওয়ানেরা। জওয়ানেরা আটক করে তাকে জানান, এভাবে সুপারি নিয়ে যাওয়া যায় না। কিশোরী বলে,” আমি আইন জানি না । পেটের দায়, সামান্য সুপারি নিয়ে যাচ্ছি।” তখন তাকে সেখান থেকে ছেড়ে দেওয়া হয় । এভাবেই নেপাল থেকে ভারতে তার সুপারি নিয়ে আসার কাজ শুরু।এরপর সাইকেলের সঙ্গে জেরিকেন বেঁধে নেপাল থেকে ভারতে কেরোসিন তেল পাচারের কাজে সে লিপ্ত হয়। একদিকে সুপারি পাচার, আরেকদিকে কেরোসিন তেল পাচার –এই মিলে পরিস্থিতি তাকে পাক্কা পাচারকারী হিসাবে চিহ্নিত করে। এভাবে চলতে চলতেই একদিন সেই কিশোরী বিখ্যাত সুপারি পাচারকারী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। এমনও দিন গিয়েছে সুপারি বাদে, চীনের তৈরি ছোট ছোট তালা গোটা শরীরে ফিট করে তার ওপর শাড়ি পড়ে বাসে চেপে সেই সব তালা নেপাল থেকে শিলিগুড়ি, শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার বড় বাজারে নিয়ে গিয়েছে সে। ধীরে ধীরে সে একজন বড় মাপের পাচারকারী হয়ে ওঠে, লক্ষ লক্ষ টাকার সুপারি পাচারকারী হিসাবে তার ব্যবসা চলতে থাকে। নাম হয়ে ওঠে পিকে। বেশ কিছু অভাবী মহিলা এমনকি হিজড়াদেরও সে সেই পাচারের কাজে নামিয়ে দেয়। এভাবে চলতে চলতেই একদিন এসএসবি জওয়ানেরা তাকে পরামর্শ দেয়,” তুমিতো অনেক অর্থ রোজগার করেছো। এবার পাচারের কাজ ছেড়ে মূল স্রোতে ফিরে আসো। তোমার ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে। তুমি ভারতীয় কোন ব্যবসায় যুক্ত হও এবং ভালো ভালো কাজ করো।” যদিও পাচারের কাজ করার সময়ই বহু দুঃস্থ ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীকে বই কেনার অর্থ তিনি দিয়েছেন। কারো মেয়ের বিয়ে না হলে তিনি সাহায্য করেছেন। কোনও অভুক্ত মানুষকে দেখলে তাকে খেতে দিয়েছেন। পাচারের কাজ করতে করতেই তার মনে পড়তো, একদিন তাকেও অভুক্ত অবস্থায় ঘুরতে হয়েছে, তাই পাচার করে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করলেও গরিব অসহায় মানুষের মধ্যে সেবার মনোভাব তার চলতে থাকে। এসএসবির আধিকারিকরা যখন তাকে পুনর্বাসন বা মূল স্রোতে ফিরে আসার পরামর্শ দিলেন,তখন তিনি সেই পরামর্শ গ্রহণ করলেন। এরপর তিনি শুরু করলেন ভারতীয় শাড়ির ব্যবসা। সঙ্গে ভালো ভালো কাজ। প্রায় কুড়ি বছরেরও বেশি সময় ধরে আজ পাচারের কাজ থেকে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। সেই সঙ্গে নিজের সঞ্চয়ের অর্থ দিয়ে একের পর এক ভালো কাজ করে যেতে থাকেন নিঃশব্দে। করোনা লকডাউন শুরুর সময় তিনি দেখলেন, বহু মানুষ অভুক্ত। তিনি ভাবলেন, এতো জমিজমা রেখে কি লাভ? মানুষ না খেয়ে মরবে, আর তিনি জমিজমা রেখে দেবেন –এটা কেমন কথা?
যেমন ভাবা তেমনি কাজ। তিনি ৩০ লক্ষ টাকায় তার কিছু জমি বিক্রি করলে এরমধ্যে থেকে ১৫ লক্ষ টাকা ব্যয় করেন লকডাউনে বহু অভুক্ত মানুষের সেবায়। দিনরাত বহু অভুক্ত মানুষকে তিনি খেতে দিলেন। এরপর তার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভক্তিনগর শ্রদ্ধা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি তৈরি হলো। সেই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে তিনি একের পর এক অসাধারণ মানবিক কাজ করে যেতে থাকলেন। রাস্তার ধারে ভবঘুরে যেসব মানসিক ভারসাম্যহীন প্রস্রাব পায়খানা করে পড়ে থাকে, যারা চুল দাড়ি না কেটে পড়ে থাকে –তাদেরকে তিনি দিনের পর দিন চুল দাড়ি কেটে স্নান করিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করতে থাকলেন।এমনকি শিলিগুড়ি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মীরা তার সহযোগিতা নিয়ে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ভবঘুরেদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজ করাতে থাকেন। তার কথায়,” পুলিশের ডাকে সাড়া দিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে । কারণ আমার তো আইপিএস হওয়ার ইচ্ছে ছিল, সেই ইচ্ছে তো বাস্তবায়িত হলো না। কিন্তু পুলিশের সঙ্গে তো কাজ করা যাচ্ছে।” এর বাইরে কোনও গরিব অসুস্থ মানুষ টাকার অভাবে ওষুধ কিনতে না পারলে তিনি তাদেরকে ওষুধ কিনে দিচ্ছেন। তাছাড়া অভুক্ত মানুষ দেখলেই তিনি তাদেরকে খাদ্য সামগ্রী তুলে দিচ্ছেন। আবার কোনও মেয়ে পাচারকারীদের খপ্পড়ে পড়লে তিনি তাদের উদ্ধার করে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছেন পুলিশের সহযোগিতায়। এভাবে অসাধারণ সব শ্রদ্ধাপূর্ণ কাজ চলতে থাকায় বিভিন্ন সংস্থা এমনকি পুলিশও তাকে সংবর্ধনা জানাতে থাকে। আজ ভক্তিনগর শ্রদ্ধা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি সমাজসেবার কাজে একটি ব্যতিক্রমী নাম হয়ে উঠেছে। আসন্ন শারদীয়া দুর্গোৎসবে বস্ত্র বিতরণসহ মানুষের সেবায় বিভিন্ন কর্মসূচি নিচ্ছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য, ” ভক্তিনগর শ্রদ্ধা ওয়েলফেয়ার কেন? কারন পাচার করার সময় আমাকে অনেকে নিচু চোখে দেখতো।কেন আমি পাচারের কাজে নাম লিখিয়েছিলাম তা কেও জানতো না।সেই কারনে কাজের মাধ্যমে শ্রদ্ধা ভক্তির ভিন্ন পরিবেশ তৈরি করতে এই ভক্তিনগর শ্রদ্ধা ওয়েলফেয়ার। ” হ্যাঁ, এবারে শুনুন সেই কিশোরীর নাম কি, যিনি একসময় পাচারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন –আজ হয়ে উঠেছেন একজন ব্যতিক্রমী সমাজসেবী। তিনি হলেন পূজা মোক্তার। পূজা নামেই সকলে তাকে চেনেন কিন্তু তার আসল নাম শিলা মোক্তার। তার যখন নদীর ধারে জন্ম হয়েছিল তখন খুব শিলা বৃষ্টি হচ্ছিল। শিলাবৃষ্টির দিন জন্ম হওয়ায় তার নাম শিলা। কিন্তু তিনি যখন অভাবের তাড়নায় পাচারের কাজে যুক্ত ছিলেন, সীমান্তে এপার ওপার করার সময় বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিতেন, সেই সময়ই একবার একজন তাকে জিজ্ঞেস করে মন্দিরের সামনে,” তোমার কি নাম?” তিনি বলে ফেলেন,” আমার নাম পূজা। পূজার ফুল নিয়ে রোজ মন্দিরে আসি। পূজার ফুল দিয়ে আমার ভালোবাসা হয়ে গিয়েছে তারা মা এর সঙ্গে। তারা মা এর সঙ্গে সেই ভালোবাসার কথা মুখে বলা যায় না। সে ভালোবাসা,সেই শ্রদ্ধা অন্তরে অনুভব করে নিতে হয়।প্রতিদিন ভক্তিভরে চোখের জলে তারা মা পুজো পান আর সেই তারা মা-ই তাঁকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ” সেই থেকে তার নাম পূজা হিসাবে প্রচারিত হয়ে যায় নেপাল সীমান্তে। তাঁর অতীতের সব কাহিনী লিখতে গেলে মহাভারত রচনা হয়ে যাবে। কিন্তু আজ তিনি অতীত ভুলে নিজেকে সংশোধন করে ভালো থেকে আরো ভালো হওয়ার কাজে নেমেছেন। তিনি বলেন, “আমি একসময় প্রচন্ড কষ্ট করেছি।অন্ন বস্ত্র কিছুই ছিলো না। খেতে পারিনি দিনের পর দিন। অনেক কষ্ট সংগ্রাম করেছি। তাই গরিব মানুষের কষ্ট দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। টাকার কেও পড়তে পারছে না শুনতে পেলে কষ্ট পাই। দুঃস্থ মেধাবীদের বই কিনে দিতে ভালোবাসি। আর ভালবাসি অভুক্ত মানুষকে খাবার তুলে দিতে।
দুর্গা পুজোর আগে পূজা দেবীর এ এক ব্যতিক্রমী কাহিনী শুনুন পূজাদেবীর মুখ থেকে —
বিস্তারিত জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন—