বাবলী রায় দেবঃ”ধ্বন্বতরী ডাক্তার সে ছিলো একজন/
বিধানচন্দ্র নামে তারে চেনে সর্বজন।” পয়লা জুলাই দিনটি ভারতবর্ষে জাতীয় চিকিৎসক দিবস হিসেবে পরিচিত।যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দিবসটি পরিচিতি পায় ১৯৩৩ সালের ৩০ মার্চ।সেদিনের অনুষ্ঠানে দেশের নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার রোগীর সম্পর্কের দিকটিও আলোচিত হয়।পরবর্তীতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ ১৯৯০ সালের ৩০ অক্টোবর ‘৩০ মার্চ’কে সেদেশে জাতীয় চিকিৎসক দিবস হিসেবে পালনের জন্য আইন পাশ করেন।
আমাদের দেশে চিকিৎসক দিবসের প্রাক্কালে চিকিৎসকদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের জন্য সেই মানুষটির আদর্শকে সামনে রেখে দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয়, যিনি বাংলার বৈভব শ্রদ্ধেয় ‘বিধানচন্দ্র রায়’। তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে তাঁর আদর্শে দেশের চিকিৎসকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ভারত সরকার ১৯৯১ সালে পহেলা জুলাইকে প্রথম জাতীয় চিকিৎসক দিবস হিসেবে ঘোষনা করেছিলেন।
আধুনিক বাংলার রূপকার বিধানচন্দ্র রায়ের বড়ো পরিচয়, তিনি ডাক্তার যাঁর চিকিৎসাধীন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ,মহাত্মা গান্ধী,
জওহরলাল নেহরু,বল্লভ ভাই প্যাটেল থেকে শুরু করে তৎকালীন বড়ো বড়ো নামকরা সব ব্যক্তিত্বরা তাঁর চিকিৎসাধীন ছিলেন।তাঁর কর্ম ব্যাপকতা ধরতে যাওয়ার অর্থ গভীর সমুদ্র থেকে এক আঁজলা জল তোলার মতো।
লোক ভগবানকে কখনও Omnipotent মনে করে যার অপরিসীম ক্ষমতা কখনও omnipresent ভাবে যার ক্ষমতার কোন সীমাবদ্ধতা নেই,যাকে চাইলেই পাওয়া যায়,যিনি সব কষ্টের সমাধান অথবা কখনও omniscient ভাবে যিনি সর্বশক্তিমান,সব কিছুতে পারদর্শী। সমাজ-সাধারণের কাছে ডাক্তারকে এই তিনের সমাহার ধরা যিনি অসীম ক্ষমতাধর ত্রিকালজ্ঞ।আমাদের মনে ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের অবস্থান ঠিক সেই জায়গায় যার জন্যই হয়তো তাঁকে ঘিরে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক গল্পগাথা।
ভারতের এই মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম এবং মৃত্যু ঘটেছিল আশি বছরের ব্যবধানে একই দিনে। ১৮৮২ সালের ১লা জুলাই পাটনায় বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম হয়েছিল।ঠিক আশি বছর পর ১৯৬২ সালে ১লা জুলাই তিনি ধরাধাম ত্যাগ করেন কোলকাতার বাসভবনে। একই দিনে জন্ম এবং মৃত্যু হয়েছিল বলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জণের সহধর্মিনী শ্রীমতি বাসন্তীদেবী তাঁর মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে শোকবার্তায় বলেছিলেন,’ বিধান ছিল পুণ্যাত্মা, তাই জন্মদিনেই চলে গেল। ভগবান বুদ্ধও তাঁর জন্মদিনে সমাধি লাভ করেছিলেন।’
অথচ বেঁচে থাকাকালীন এই পূন্যাত্মাকে অসৎ,চোরসহ নানান অপবাদ মাথায় নিয়ে বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়ছিল যার জন্য শেষ বয়সে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “আমি যখন মরব তখন ওই লোকগুলোই বলবে, ‘লোকটা ভাল ছিল গো, আরও কিছু দিন বাঁচলে পারত’।”
চিকিৎসার পাশাপাশি ৬৫ বছর বয়সে বিধানচন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বভার গ্রহন করে ভোর পাঁচটায় উঠে গীতা ও ব্রহ্মস্তোত্র পড়ে, স্নান সেরে, সাড়ে ৬টায় ব্রেকফাস্ট করে দু ঘণ্টা বিনামূল্যের রোগী দেখে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আসতেন সবার আগে।মুখ্যমন্ত্রীরূপে পশ্চিমবঙ্গকে সাজাতে একে একে তৈরী করেছেন কল্যাণী উপনগরী,কলকাতা বন্দর , সল্ট লেক, দুর্গাপুর-আসানসোলের শিল্পাঞ্চল , উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে কলকাতার বিমান সংযোগ।কেওড়াতলা শ্মশানের ইলেকট্রিক চুল্লী উদ্ভাবনের দিন হাসতে হাসতে বলেছিলেন,’আমাকে এই চুল্লীতেই দিও।’
নিজের পেশা নিয়ে রসিকতা করতেও তিনি ছিলেন ওস্তাদ।লন্ডনের উপকন্ঠে একটি বাসে কিছু গুন্ডা দ্বারা আক্রান্ত হলে বিধানচন্দ্র নিজের ব্যাগ খুলে দিয়ে বলেছিলেন,”.দেখো ছোকরা তোমার বিনয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। আমি ডাক্তার। আমরা ডাক্তাররা মানুষের টাকা আর জীবন দুই-ই নিয়ে থাকি।”
হায়দরাবাদের এক সভায় ভাষণ শেষে গল্পটি করেছিলেন স্বয়ং বিধানচন্দ্র।
‘পরের ধন অপহরণ করে নিজের বলে চালানোয় আমরা কারও থেকে কম যাই না।’ আড্ডায় বসে বন্ধুর উদ্দেশ্যে বলা উক্তিটিও বিধানচন্দ্রের।বিধানচন্দ্র ছিলেন সেই মানুষ যিনি FRCS এবং MRCP ডিগ্রি অর্জন করেছেন পরপর।
শাহজাহানকে যারা একমাত্র প্রেমিকপুরুষ বলে আখ্যায়িত করেন তাদের কাছে প্রেমিকাকে না পাওয়ার নিদর্শন হিসেবে তৈরী করে গেছেন কল্যানী উপনগরী, থেকে গেছেন চিরকুমার, দিয়ে গেছেন
প্রেমিক মনের পরিচয়।
আজ নববংলার পথিকৃত বিধানচন্দ্র রায়ের ১৩৯তম জন্মদিনে একটাই কথা বলতে হয়,’হে মৃত্যুহীন প্রাণ,তোমায় প্রণাম।’