হে ভারতভূমি, তোমারে নমি

বাবলী রায় দেব ঃ আর্যাবর্ত্ত। হিমালয়ের দক্ষিণে অবস্থিত একটি বিস্তীর্ণ ভূখন্ড।সেই ভূখণ্ড জুড়ে ছিল আমাদের বৃহত্তর ভারতবর্ষ।মনুসংহিতায় যার বর্ণনা এরূপ…. 
আসমুদ্র তু বৈ পূর্বাদাসমুদ্রাৎ তু পশ্চিমাৎ।
তয়ােরেবাস্তরং গি্যোরার্যাবর্তং বিদুর্বুধাঃ।
অর্থাৎ পূর্ব সমুদ্র হতে পশ্চিম সমুদ্র  , উত্তরে হিমালয় এবং দক্ষিণে বিন্ধ্য ও সাতপুরা পর্বতমালা পর্যন্ত বিস্তৃত ভূ-খন্ড নিয়ে গঠিত  আর্যাবর্ত ছিল এমন এক আশ্চর্য ভূখণ্ড,যার তুলনা মেলা ভার এই পৃথিবীতে।বৃহত্তর ভারতবর্ষ ছিল সেই আর্যাবর্ত। ঐতিহাসিকদের অনুমান, আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে আর্যরা ভারতবর্ষে আসেন এবং এখানকার আদিম অধিবাসীদের অনার্য নামে আখ্যায়িত করে দূরে সরিয়ে দিয়ে এখানকার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক পৃথক সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন যাকে  আর্য্যবর্ত্ত নামে অবিহিত করা হয়।
ধন-মান,শৌর্যে, সম্পদশালী, সর্বাপেক্ষা অগ্রণী আর্যাবর্ত্তের মানুষ খুব নিশ্চিন্তে জীবনযাপন করতেন।সেখানকার ভুখন্ডের উর্বরতার কারণে অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমেই পর্যাপ্ত পরিমান কৃষিপণ্য উৎপাদিত হতো।ফলে সেখানকার অধিবাসীরা শিল্প কলা,বিজ্ঞান, দর্শন ছাড়াও বিভিন্ন শাস্ত্রে পারদর্শী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মাচরণ,
সাহিত্যচর্চা এবং মননশীল চিন্তাধারার অফুরন্ত সময় এবং সুযোগ পেয়েছিলেন।যুগ যুগ ধরে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে মৌর্য , গুপ্ত , কুষাণ, প্রভৃতি সভ্যতার মধ্য দিয়ে ।
সেখানে বর্ণাশ্রম-ধর্মের বিকার ছিল না।বংশলোপ হতো না।অনর্থক উৎপাত ছিল না।ভাগীরথী গঙ্গার সুশীতল স্পর্শে পবিত্র ও সুন্দর আর্য-অনার্যদের বাস ভূমি ছিল এই আর্যাবর্ত। পুণ্যবান জনেদের বাসভূমি সম্পদের আশ্রয়, সাধুলোকেদের শোভন ব্যবহারে, শিক্ষিত জনেদের প্রাচুর্যে স্বর্গতুল্য এই বাসভূমি এককথায় ‘পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য’।

কবি ত্রিবিক্রম ভট্টের বর্ণনায় ফুটে ওঠে আর্যাবর্ত্তের রূপচিত্রন।
কবি সিংহাদিত্য নামেও পরিচিত ছিলেন।তাঁর তিনটি অমর সংস্কৃত শিলালেখর নাম …মদালসা চম্পূ, নৌমারী  এবং নলচম্পূ।এই  নলচম্পূ কাব্যের প্রথম উচ্ছ্বাসের নাম হল আর্যবর্তবর্ণনম্।আর্যবর্তবর্ণনমের অর্থ .. আর্য অর্থাৎ  শ্রেষ্ঠ পুরষেরা যে স্থানে বারবার আবর্তিত হন,সেই স্থান হল আর্যাবর্ত। সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ট, স্বর্গের তুল্য অত্যন্ত মনোহর ও সমৃদ্ধ এই ভূখণ্ড সম্পর্কে
কবি ত্রিবিক্রম ভট্ট বলেছেন..“কথংচাসৌ স্বর্গান্ন বিশিষ্যতে?”
কবির বর্ণনায় ফুটে ওঠে আর্যাবর্তের বিশিষ্টতা।
সুউচ্চ বৃক্ষশোভিত জন্মস্থান, উদ্যান, বাটিকা, বিটপিতে পরিপূর্ণ আর্যাবর্ত্তে সবই ছিল।ছিল না কেবল বিট-চেট অর্থাৎ লম্পট দুশ্চরিত্রের চিহ্ন।এখানকার নারীরা সতীব্রত করতেন।তারা ছিলেন নিষ্কলঙ্ক কুলবধূ।স্বর্গাপেক্ষাও বেশি সম্পদে সম্পদশালী আর্যাবর্ত্তে ছিল ইন্দ্রতুল্য রাজার শাসন অথচ তিনি ইন্দ্রের মতো সুরাপানে আসক্ত ছিলেন না।সুরশ্রেষ্ঠ রাজার সুশাসনে মানুষ ছিলেন সুখী।আর্যাবর্ত্তের স্বর্গরাজ্য সরগরম থাকতো ধর্মকর্মের অনুষ্ঠানে।বৈয়াকরণরা স্ফোটবাদতত্ত্ব অর্থাৎ ব‍্যাকরণ আলোচনায়  নিমগ্ন থাকতেন।এখানকার বাতাস সংগীতবাদ্যে মুখরিত হতো।জ্যোতিষশাস্ত্রের আলোচনা হতো কিন্তু গ্রহদোষের উপদ্রব ছিল না।বৃক্ষ,লতাগুল্মাদি এবং শস্য বেড়ে উঠতো অনায়াসে, সৃষ্টির উল্লাসে অনায়াসে।পর্বত- চারণভূমিতে ছিল পশুদের উল্লম্ফন।ছিল না তাতে গন্ডরোগের চিহ্ন।প্রজারা ফোঁড়াব্যাধিতে যন্ত্রনা পেতেন না।
রোগব্যাধিতে প্রাণক্ষয়ের আশঙ্কা ছিল না।মানুষ শতবর্ষ পরিমাণ পূর্ণ আয় নিয়ে বেঁচে থাকতেন।স্বেচ্ছায় সমাধিস্থ হতেন।
কবির লেখনীতে সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয় আর্যাবর্তের অপূর্ব  রূপ  বর্ণন।সমৃদ্ধ আর্যাবর্তের বর্ণনার সঙ্গে ফুটে ওঠে সেখানকার মানুষের জীবনচরিত্র এবং আর্যাবর্তের প্রতি গভীর মমত্ববোধ।

প্রানাধিক প্রিয় আর্যাবর্ত্তের শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার মাধ্যমে ছিল
হিমালয় পর্বতের উত্তর-পশিম ও উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত খাইবার পাস , জোজিলা পাস ও নাথুলা পাসসহ অন‍্যান‍্য  গিরিপথগুলো।এই পথ ধরে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হয় আর্যাবর্ত্তের এবং  এই মাধ্যম ধরেই যুগে যুগে দূর্গম মরুপ্রান্তর থেকে এসেছে আর্য-গ্রীক,শক-তুর্কি, হূণ-পাঠান-মোঘলদের মতো দুর্বৃত্তরা।তারা মৈত্রী-স্থাপনে আগে চালিয়েছে যথেচ্ছ ধ্বংশলীলা।ভারত ভূখণ্ডে সাম্রাজ্য বিস্তার ও লুটতরাজ চালিয়ে ওইসব বিদেশী আক্রমণকারীর দল একদিকে যেমন অশান্তি ও অত্যাচারের  বাতাবরণ সৃষ্টি করেছে তেমনি  করেছে প্রাচীন ঐতিহ্য সংস্কৃতির ধ্বংসসাধন। অনাহূত বিদেশীদের আক্রমণে তছনছ হয়ে গেছে আর্যাবর্তের প্রাচীন ইতিহাস।হারিয়ে গেছে দলিল দস্তাবেজ।
দেশের সম্পদ লুঠ করে আজ তারা হয়েছে আমীর আর তাদের হাতে সব লুটিয়ে দিয়ে বিশ্বের দরবারে ভারত আজ গরীব দেশ।
কবিকে তাই খেদের সঙ্গে বলতে হয়..
মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়/ মাথায় তুলে নে রে ভাই ;
দীন-দুঃখিনী মা যে তোদের /তার বেশী আর সাধ্য নাই |

আমার ঘরে আমি রাজা।সেই রাজত্বে কেউ ভাগ বসাতে এলে
নিজ গৃহেই তখন পরবাসী হয়ে থাকতে হয়।প্রমাণ আমাদের মহাভারত।কৌরবরা ষড়যন্ত্র করে যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলায় হারিয়ে পাণ্ডবদের বারো বছরের জন্য বনবাস এবং এক বছরের জন‍্য অজ্ঞাতবাসে পাঠায়।সেই সময় অঙ্গীকার করে,তেরো বছর পর পান্ডবরা ফিরে এলে তাদের রাজ‍্য তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং ততদিন পর্যন্ত রাজ্য শাসন করবে কৌরবরা।তেরো বছর পর পাণ্ডবরা ফিরে এলে কৌরবরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে অস্বীকার করে।এই পরিস্থিতিতেই 
শ্রীকৃষ্ণ কোনো পক্ষ অবলম্বন না করে রক্তপাত এড়ানোর জন্য শান্তিদূত হিসাবে দুর্যোধনের কাছে থেকে পান্ডবদের জন্য পুরো রাজ্যের বদলে পাঁচ পাণ্ডবের জন্য পাঁচটি গ্রাম ভিক্ষে চান। কিন্তু দুর্যোধন এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দম্ভের সঙ্গে বলেন,’বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী!’ অর্থাৎ একটি সুঁইয়ের অগ্রভাগে যে কণা পরিমাণ ভূমি রাখা যায় তাও পাণ্ডবদের দেওয়া হবে না যতক্ষণ না তারা যুদ্ধ জয় করে সেটা অর্জন করছে।
ঠিক তেমনি ‘অতিথি দেব ভব’ জ্ঞানের বশবর্তী হয়ে অতিথিকে আশ্রয় দেওয়ার অর্থ নিজের সর্বনাশ ডেকে আনা।প্রমাণ মহাভারতের শকুনী।ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয়ে থেকে ধৃতরাষ্ট্রের শতপুত্রের মৃত্যুর কারণ ছিল তার কুপরামর্শ।
উভয় ক্ষেত্রে একটি কথাই প্রমাণ করে,বাইরের লোক ঘরের শান্তি বিঘ্নিত করে।এমনটাই হয়েছে মহাভারতের ভারতের।তবুও আমরা আমাদের শত্রুদের চিনতে পারিনি।অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে হতে পারিনি ঐক্যবদ্ধ।

‘শত্রুকে ভালো বাসো’ যিশুর বানীকে শিরোধার্য করে বিদেশী সংস্কৃতিতে আপ্লুত হয়ে শত্রুকে ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে   ভালোবেসে আপন করে নিয়েছি, ভুলে গেছি রামায়ণ-মহাভারতের শিক্ষা।তার মূল্য চোকাতে হয়েছে বারংবার।বৈদেশিক আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত হতে হয়েছে ভারতের পূণ্য ভূমি।আমরা তাদের শিকার হয়েছি, স্বীকার করেছি দাসত্ব।মহান হয়েছে তাদের ধ্বংশলীলা।মন মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে দাসত্বের শৃঙ্খল।সেই শৃংখল নাগপাশের মতো মনমননকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এই শতকেও।শত্রু-মিত্রের পার্থক্য ভুলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে রক্ষার পরিবর্তে স্বার্থসিদ্ধির তাগিদে নিজের সঙ্গে সঙ্গে দেশকে বেচে দিতেও পিছপা হই না।

ভারত সেই সুমিষ্ট ফলের গাছটির মতো,সেজন‍্যই বার বার  বৈদেশিক আক্রমণের শিকার হয়েছে বলে তাদের পক্ষে রায় দেন  যারা,তারা কোনো মতেই অস্বীকার করতে পারেন না,সেদিন যে মনোবৃত্তি নিয়ে মামুদ,ঘুরি,খিলজীরা ভারতীয় মন্দিরগুলির ধ্বংস সাধন করে লুটপাট চালিয়েছিল সেই মনোবৃত্তির অস্তিত্ব এই শতকে বিন্দুমাত্র নেই।অথচ মজার কথা ভারতের ইতিহাস সেই ধ্বংস সাধকদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।নইলে জয়পালা, জয়চাঁদ, ললিতাদিত‍্য,রামলাল খোকরদের ছেড়ে ঘুরী,গিলজী,গজনী, বাবরদের দিন তারিকসহ বংশ পরিচয় মুখস্থ করতে হয়??

এখানেও সেই একই কথা বলতে হয়।দাসত্বের শৃঙ্খলে থেকে,  আমরাও বিধর্মীদের মতো পরধনে বড়ো কাতর হয়ে পড়েছি।সঙ্গ দোষ যে বড়ো দোষ।নইলে নিজ দেশের বীরত্বের কাহিনী তুলে ধরার বদলে নিজে দেশের দুর্দশার কথা গর্ব সহকারে উচ্চারণ করি কি করে??
সত্যই,বিচিত্র এই দেশ!!
বিদেশীয়ানায় আচ্ছন্ন মস্তিষ্ক সেলুকাসের ভাষায় এই কথাই বলে।

স্বাধীনতা সকলের খুব প্রিয়।স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে স্বাধীনতা ভোগ করতে সবাই চায়।কিন্তু ভুলে যায় স্বাধীনতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব।ইতিহাসে যুগধর্ম বলে একটা কথা আছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সেই কথাই আবার বলছি।
আমরা খুব কষ্ট করে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি।বৈদেশিক চক্রান্তে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে ভারত ভূখণ্ড।নারকীয় যন্ত্রণার শিকার
হয়েছেন পূর্বপুরুষেরা।পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে তাঁরা আমাদের দিয়েছেন স্বাধীন ভারত।আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক।
এই স্বাধীনতা,এই স্বাধিকার আদায়ের জন্য যাঁরা নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে মৃত্যু বরণ করেছেন তাঁরা আজ অতীত।তাঁদের কেউ বা বেঁচে আছেন ইতিহাসের পাতায় কেউ বা হারিয়ে গেছেন কালের অতলে।কিন্তু যে জন্য তাঁদের ওই আত্মবলিদান সেই বলিদানের যথার্থ সম্মান কি আমরা দিতে পেরেছি??
সময় এসেছে।বিভেদ বৈষম্য ভুলে,ক্ষুদ্র স্বার্থ ত‍্যাগ করে মহান যে ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি সেই ভারতভূমির ঐতিহ্য ও সম্প্রীতি রক্ষার স্বার্থে  ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমে ব্রতী হওয়া।তবেই হবে মহান সেই বীর-বিপ্লবী,রাজা-মহারাদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা নিবেদন।বন্দেমাতরম।।