কি করে তিনি চিত্র শিল্পী, লিখেছেন ডালিয়া চক্রবর্তী

শিল্পী পালিতঃ কি করে তিনি চিত্র শিল্পী, লিখেছেন ডালিয়া চক্রবর্তী। পড়ুন তাঁর কলমে —

আমি ডালিয়া চক্রবর্তী। নিজের শিল্পী জীবন নিয়ে লিখতে বসে প্রথমেই ধন্যবাদ জানাই বীণাপাণি শিল্পী দিদিকে। দিদি যদি নিজে থেকে আমার বিষয়ে আগ্রহী না হতেন অথবা আমার আঁকা ছবি দিয়ে আমার শিল্পী জীবন সম্পর্কে লিখতে অনুরোধ না করতেন তাহলে কোনদিনই আমার আর সেটা লেখা হয়ে উঠত না হয়তো।তা দিদিকে আমার আন্তরিক প্রনাম 🙏

আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী। প্রথমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক হই ও পরে রবীন্দ্র সাহিত্যের প্রতি ভীষণ আগ্রহী থাকায় রবীন্দ্রভারতী থেকে রবীন্দ্র সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রি কোর্স কমপ্লিট করেছি। বাবা ছিলেন একজন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী ও কলকাতার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত মহলের বিশেষ পরিচিত নাম। হারমোনিয়াম আর্টিস্ট শ্রী পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী। বাবা সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখায় পারদর্শী ছিলেন । যেমন – কন্ঠ সঙ্গীত (ভোকাল ), হারমোনিয়াম বাজনা, পল্লীগীতি, রবীন্দ্র সঙ্গীত ও আধুনিক গানে সমান পারদর্শী। কমবয়সে পল্লীগীতিতে জনপ্রিয় পল্লীগীতি শিল্পী শ্রী নির্মলেন্দু চৌধুরীর একনিষ্ঠ ছাত্র ছিলেন। পরবর্তী কালে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লক্ষৌ ঘরানার বিভিন্ন উস্তাদদের কাছে তালিম নেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে। এবং আরো পরে হারমোনিয়াম বাজনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পন্ডিত সোহনলাল শর্মা ও পন্ডিত জয়ন্ত বোসের ( তবলিয়া কুমার বোসের মেজ দাদা) কাছে নাড়া বাঁধেন ও হারমোনিয়াম বাজনায় তালিম নেন। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে বাবার অনেক আগ্রহ ছিল। যেমন সাহিত্যে। প্রচুর পড়াশোনা করতেন এই বিষয়েও। বিভিন্ন গান লেখা, সুর দেওয়া ও কবিতা লেখা ইত্যাদিতেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ছোট থেকেই আমি একটা ভালো পরিবার ও পরিবেশ পেয়েছিলাম এবং স্বাভাবিক নিয়মেই আমার শিল্প সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ জন্মে উঠেছিল।

এইবার আসি নিজের কথায়। বীণাপাণি শিল্পী দি বলেছেন আমার অঙ্কন শিল্প জীবন নিয়ে কিছু লিখতে। কিন্তু সত্যি বলতে আমি তো কোনদিন কারো কাছে আঁকাই শিখিনি।ওই স্কুলের আঁকা ক্লাসে যেটুকু শেখা আর বাকিটা নিজের আগ্রহ ও ইচ্ছায় চালিয়ে যাওয়া।কোনদিন কোনও কোচিং ক্লাসে এর জন্য ভর্তি হইনি। তবে ওই যে বললাম পরিবারে সেটা ছিল। আমার ছোটপিসির আঁকায় বেশ ভালো হাত ছিল। ওই ছোটবেলায় পিসির সঙ্গে লক্ষ্মীপূজার আলপনা দিতে শেখা বা স্কুলের ড্রয়িং খাতায় পদ্মফুল বা কোনো পশুপাখি আঁকতে শেখা — ওই টুকিটাকি দিয়ে শুরু।আমার ছোট পিসিমনিই আমার প্রাথমিক শিক্ষিকা ছিল এই বিষয়ে বলা যায়। তবে যতই বড় হয়েছি ব্যাপারটা পুরোপুরি সেল্ফ ডিপেন্ডেড হয়ে গেছে।

কোনো কোচিং সেন্টারে আঁকা না শিখতে যাওয়ার আরো একটা কারণ ছিল। আমি কলকাতার সোদপুর অঞ্চলের বাসিন্দা। বাবার সোদপুরে বেশ বড়ো একটা নাচ গানের স্কুল ছিল। নাম ” গীতবিতান”। বাবা ভীষণ ব্যস্ত মানুষ ছিলেন। নিজের সরকারি চাকরি , গানবাজনার জগৎ ও গানের স্কুল এইসব নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতেন যে ছোটবেলায় আমাদের সময় দিতে পারতেন না। মা ও একান্নবর্তী পরিবারের বড়ো বৌ হবার কারণে ও ব্যস্ত মানুষের স্ত্রী হবার কারণে সময় কম দিতেন। আমরা ঠাকুরমা, ঠাকুরদা, কাকা পিসি এদের সান্নিধ্যই বেশি পেয়েছিলাম। বাড়িতে শিল্প সাহিত্যের পরিবেশ ছিল বরাবরই। বাবা ছাড়াও তিন পিসি সবাই গানবাজনা জানত। কেউ রবীন্দ্র সঙ্গীত, কেউ বা গীটার, কেউ বা শাস্ত্রীয় সংগীত।আর কাকা তবলা। তবে সবার মধ্যমনি ও উদ্যোক্তা আমার বাবা ই ছিলেন।আমার চার বছর বয়স থেকে পড়াশোনার জীবন শুরু হয়। সেইসঙ্গে বাবার গানের স্কুলে নাচ, গান শিক্ষা শুরু হয়। তাছাড়া পাড়ার ক্লাবে নাচগানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম আমরা দুই বোন। ক্লাব থেকে জায়গায় জায়গায় নাচের জন্য বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে নিয়ে যেত আমাদের। সুতরাং আমরাও ছোট থেকে ভীষণ ভীষণ বিজি থাকতাম ওইটুকু বয়সেই। তাই আলাদাভাবে আঁকাটা আর শেখা হয়নি। পরবর্তীকালে লেখাপড়ার ব্যাপারে আরো ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তবে বাবা মা খুব উৎসাহ দিতেন আঁকার বিষয়ে। মা এখনো দেয়। বাবাও বলতেন একজন ভালো শিক্ষকের কাছে অনুশীলন করতে। কিন্তু বিভিন্ন কাজের চাপে আর হয়নি সেটা। তবে চেষ্টা অব্যাহত থেকেছে।

একটু বড়ো হবার পর এই বারো তেরো বয়স থেকে বাবার সঙ্গে সঙ্গে নানা অনুষ্ঠানে যেতাম। কাকে না দেখেছি !! পন্ডিত রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, তাঁর ছেলে শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়, আমান আলি বঙ্গাশ, আমন আলি বঙ্গাশ (স্বনামধন্য সরোদিয়া আকবর আলি খানের দুই স্বনামধন্য পুত্র), হৈমন্তী শুক্লা, পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী, স্বনামধন্য তবলিয়া উস্তাদ জাকির হুসেন, নাচে বিরজু মহারাজ ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের আরো সব নামীদামী ব্যক্তিত্বদের একদম সামনে থেকে দেখেছি ও তাদের চরনধূলি পেয়ে জীবন সার্থক করেছি। এনাদের সঙ্গে বাবা এক স্টেজ শেয়ার করতেন। কলকাতা সহ দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে যেমন- গুজরাটের আহমেদাবাদ বা উড়িষ্যা বা বিহারের ধানবাদ থেকে বায়না করে নিয়ে যেত আমার বাবা ও তার গ্রুপকে। আমি ও কিছু কিছু জায়গায় সঙ্গী হতাম। ভীষন ভালো লাগতো।

নাচ, গান, লেখাপড়া বা আঁকা এসবের সঙ্গে একটু আধটু সাহিত্য চর্চাও করতাম। তবে ওই ঘরের কোনে। নিজের একান্ত ডায়েরি টুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। নিজের খুব কাছের দু চারজন বন্ধু বাদে আর নিজের পরিবার ও মা বাবা বাদে কেউ জানত না। এই বিষয়েও বাবা খুব উৎসাহ দিতেন। বলতেন ” তুই আমার মেয়ে হয়ে লুকিয়ে সাহিত্য চর্চা করিস কেন ?! তোর তো রীতিমত গর্ব করা উচিত এই বিষয়ে!” পরবর্তীকালে চাকরি করতে এসে ও ফেসবুকে আর পাঁচটা বন্ধুর দেখাদেখি উৎসাহিত হয়ে এবার প্রকাশ্যে কলম ধরলাম। অনেকের পছন্দ হলো আমার লেখা। পরিচিতি ও স্বীকৃতি পেল। বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনে আমার লেখা ছাপানোও হলো বন্ধু সম্পাদক মন্ডলীর উদ্যোগে। আঁকাটাও কখনো জাহির করতে যাইনি। ড্রয়িং খাতাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। রিসেন্টলি দু একটা আঁকা ফেসবুকে ফ্রেন্ডসে আপলোড করেছিলাম। বীণাপাণি দিদির নজরে পড়ল ও উৎসাহিত করলেন। এবং একদিন আমার দশটি আঁকা দিতে বললেন এই লেখাসহ। তাই আজ আমার এই হবিটাও জনসমক্ষে এলো। দিদিকে আবার অনেক ধন্যবাদ ❤️🙏