নিজস্ব প্রতিবেদন ঃঃ কোচবিহার রাজ পরিবারের স্মৃতি নিয়ে শিলিগুড়িতে শহরে বহুদিন ধরে দিব্যি আছেন ৯৫ বছর বয়স্ক জগদীশ চন্দ্র সরকার। শিলিগুড়ি সুকান্ত নগরে তার বাড়ি। সম্প্রতি তিনি তার এক পুত্রকে হারিয়েছেন। তার আগে হারিয়েছেন পুত্র বধূ ও স্ত্রীকে। বহু শোক যন্ত্রণার মধ্যেও কোচবিহার রাজ পরিবারে মহারাজাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন সময় কাটানোর স্মৃতি তাকে বাড়তি অক্সিজেন জোগায়।
কোচবিহার জেলার কোতয়ালি থানার গুড়িয়াহাটি পোস্ট অফিসের ব্যাঙচাতরা রোডে ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে জন্ম জগদীশ চন্দ্র সরকারের। তার বাবার নাম ছিল যাদব চন্দ্র সরকার। ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে জগদীশবাবু তার বাবা এবং দুই দাদা রমেশ চন্দ্র সরকার এবং কনক চন্দ্র সরকারকে হারান। তারা সকলে কলেরায় মারা যান।১৯৪৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত কোচবিহার মহারাজার চাকরিতে ছিলেন জগদীশবাবু।
১৯৫০ সালের পয়লা জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের প্রধানমন্ত্রী ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় কোচবিহার রাজ্যকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করে একটি জেলায় পরিণত করেন। সেই দিন থেকে কোচবিহার রাজ্যের সব কর্মচারীকে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারি হিসাবে গ্রহণ করা হয়। হাউসহোল্ড ডিপার্টমেন্টের কর্মচারীদের মধ্যে মহারাজা ভূপবাহাদুর যাদের রাখলেন ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের পেনশনের ব্যবস্থা করেছিলেন। মহারাজা ভূপবাহাদুর সেইসব কর্মচারীদের জন্য নতুন পেনশন, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করে চুক্তি করেন। জগদীশবাবুরা সেইদিন থেকে কোচবিহার মহারাজা ভূপবাহাদুরের প্রাইভেট কর্মচারী হিসাবে থেকে যান। ১৯৭০ সালে কোচবিহার মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ন ভূপবাহাদুর প্রয়াত হন। তার কোনো সন্তান না থাকায় ভাতুস্পুত্র বীরাজেন্দ্র নারায়নকে মহারাজা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজকীয় প্রথা অনুযায়ী অনুষ্ঠান করে বীরাজেন্দ্র নারায়নকে সিংহাসনে বসানো হয়। রাজন্যভাতা বিলোপ হওয়ার পর মহারাজা বীরাজেন্দ্র নারায়নের পক্ষে সব কর্মচারীকে রাখা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি কর্মচারীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী তাদেরকে গ্র্যাচুইটি দেবার অর্থের অভাব থাকায় রাজবাড়ি এলাকার ভিতর থেকে কর্মচারীর শ্রেনী হিসেবে টাকার পরিবর্তে জমি দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুযায়ী ১৯৭১ সালে দশ কাঠা জমি নিয়ে রাজবাড়ির চাকরি ছেড়ে চলে আসেন জগদীশবাবু। তিনি রাজবাড়িতে রেকর্ড কীপার হিসাবে কাজ করেছেন।
১৯৫৭ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত কোচবিহার জেলার সদর মহকুমার গুড়িয়াহাটি গ্রামের আদায়কারী পঞ্চায়েত ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত গুড়িয়াহাটি অঞ্চল পঞ্চায়েতের উপপ্রধান ছিলেন তিনি। তারপর ১৯৬২ থেকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত কোচবিহার এক নম্বর ব্লক কংগ্রেস কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত কোচবিহার জেলা কংগ্রেস কমিটির সদস্য ছিলেন জগদীশবাবু। তারপর ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত কোচবিহার জেলা কংগ্রেস কমিটির কোষাধ্যক্ষছিলেন তিনি। তারপর শিলিগুড়ি সুকান্তনগরে এসে বাড়ি তৈরি করে বসবাস শুরু করেন। শিলিগুড়িতে সম্মানের সঙ্গে তাকে ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ পদ দেওয়া হয়। কিন্তু এখন আর তিনি বয়সের কারনে রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারেন না। বাড়িতে বসে তিনি তার রাজবাড়ির সময়কার বিভিন্ন স্মৃতি রোমন্থন করেন। আমার জীবন কাহিনী এবং স্মৃতির আলোয় কোচবিহার ও অন্যান্য প্রবন্ধ নামে দুটি বইও লিখেছেন। তার ছোট কন্যা নন্দিতা ভৌমিক বলেন, আমার বাবার কাছে অনেক রাজা মহারাজার ছবি আছে। তাছাড়া আরও অনেক মূল্যবান স্মৃতি আছে। সেসব কাজে লাগতে পারে ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের।