করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পরও স্কুলের খবর নিয়মিত নিয়েছেন এই শিক্ষক,অন্যধরনের বিদ্যাসাগর!!!

বাপি ঘোষ ঃগত বছরের ২০ নভেম্বর তিনি করোনায় আক্রান্ত হন, অবস্থা এমন হয় যে তিনি একসময় মৃত্যু মুখে চলে যান।টানা ৫২ দিন আই সি সিইউতে ছিলেন, কেও মসজিদে কেও মন্দিরে তাঁর প্রান ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য আল্লা বা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা শুরু করেন, তার গলার মধ্যে ফুটো করে বিশেষ পদ্ধতিতে অক্সিজেন পৌছানো হয় আর একসময় যেন সব মিরাক্যাল হয়ে ওঠে, তিনি শেষমেষ মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন আর সুস্থ হতেই তিনি নেমে পড়েছেন নিজের মডেল স্কুল মুরলীগঞ্জ হাই স্কুলের উন্নতিতে।তিনি নেমে পড়েছেন রাজ্যের শিক্ষা পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নয়ন ভাবনায়।শুধু এমনটাই কেন, করোনায় যখন তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সেই সময়ও খবর নিয়েছেন তাঁর প্রিয় প্রানের স্কুলে ফুল গাছগুলোতে ঠিকঠাক জল দেওয়া হচ্ছে কিনা,স্কুলটা ঠিকঠাক আছে কিনা। আসলে এতটা গভীরে গিয়ে আন্তরিকভাবে বিদ্যা উপাসনার স্থলকে ভালোবেসেছেন বলেইতো তিনি আমাদের শিক্ষা রত্ন।গতবছরই রাজ্য সরকার তাঁকে শিক্ষা রত্ন পুরস্কার দিয়েছে। আর শিক্ষা রত্ন বাবদ প্রাপ্ত অর্থও তিনি বিধান নগরের ভীম ভার দৃষ্টিহীন বিদ্যালয় এবং অন্য দুঃস্থদের মধ্যে দান করে দিয়েছেন। হ্যা, ব্যতিক্রমী, একদম ব্যতিক্রমী স্কুল শিক্ষক সামসুল আলমের কথাই বলা হচ্ছে।
পরাধীন ভারতে আমরা শুনেছি পন্ডিত ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাম।আমরা পড়েছি শিক্ষার প্রসারে তাঁর মহান সব অবদানের কথা। আজকের দিনেও বিদ্যাসাগরের মতো একেবারে জেরক্স কপি না পাওয়া গেলেও শিক্ষার প্রসারে অন্যরকম বিদ্যাসাগরেরা অনেক আছেন।সামসুল আলমকে তাদের মধ্যে একজন বললেও ভুল হবে না। শিলিগুড়ি মহকুমার বিধান নগর এলাকার মুরলীগঞ্জ হাইস্কুল আজ রাজ্যতো বটেই আন্তর্জাতিক স্তরেও একটি উল্লেখযোগ্য নাম মডেল স্কুল হিসাবে। আর চাবাগান অধ্যুষিত পিছিয়ে পড়া একটি স্কুলকে রাজ্যের অন্যতম সেরা স্কুলে রুপ দিতে তাঁর অবদান একেবারে বলা যায় একশতে একশ।সরকারি স্কুল অনুন্নত, সরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েকে পড়তে না পাঠিয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়তে পাঠানো অনেক ভালো বলে যেসব অভিভাবক ভাবছেন তাদের সেই চিন্তা ভাবনাকে ধাক্কা দিয়েছেন প্রতিভাবান শিক্ষক সামসুলবাবু।অল্প কথায় এই স্কুলের পঠনপাঠন, উন্নতির কথা মেলে ধরা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায় এই স্কুল বহু ইংরেজি মাধ্যমকে টেক্কা দিচ্ছে শিক্ষার গুনগত মান থেকে অন্য কিছুতেও।আজ আমরা মাস্ক নিয়ে আমরা হইচই করছি কিন্তু এই স্কুলে করোনা শুরু হওয়ার অনেক আগে ২০১৩ সালে মিড ডি মিল রান্নার সময় মুখে মাস্ক বেঁধে রাখার রীতি চালু হয়। আজ আমরা করোনা পরিস্থিতিতে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে শিক্ষা নিয়ে চিৎকার করছি কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার আগেই তাঁর স্কুলে সেই প্রয়াস শুরু হয়।প্রধান শিক্ষক হিসাবে স্কুলের উন্নতিতে সমস্ত শিক্ষক সহকর্মী, অশিক্ষক কর্মী সকলকে নিয়ে তিনি এগিয়ে চলার কাজে নেমেছেন এক পরিবারের মতো।স্কুলে তাঁর উদ্যোগে বাসও চালু হয়েছে। একটা সরকারি স্কুল যে এত সুন্দর সাজানো গোছানো তা ভাবা যায় না। বাইরে থেকে অনেকে হঠাৎ সে স্কুলে গিয়ে প্রাইভেট স্কুল ভেবে ভুল করেন। আর্থিক দিক থেকে অনগ্রসর এলাকা হলেও সে স্কুলে ছাত্রদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো হচ্ছে রীতিমতো ঘষেমেজে। আজ রাজ্যে স্টেট রিসোর্স পার্সন হিসাবেও তিনি সব সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের রীতিমতো ক্লাস নিচ্ছেন বিদ্যালয় শিক্ষার উন্নতিতে।শিক্ষক পরিবারেই তাঁর জন্ম।বাবা খাদেম রসুল ছিলেন শিক্ষক।পরিবারের অন্যরাও সকলে শিক্ষক বা অধ্যাপনায় যুক্ত। উত্তর ২৪ পরগনা জেলার রাউতরা গ্রামে তাঁর জন্ম।গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক পাঠ চুকিয়ে অশোকনগর বয়েজ সেকেন্ডারি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক। তারপর রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। পরে কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এড।এরপর এডাল্ট এডুকেশনে পোস্ট গ্রাজুয়েট করতে করতেই ১৯৯৭ সালে চাকরি। প্রথম সহ শিক্ষক শিলিগুড়ি জগদীশ চন্দ্র বিদ্যাপীঠে।সেখানে ছয় বছর কাজ করার পর ২০০৪ সালে মুরলীগঞ্জ হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজে যোগদান। ছোট থেকেই তাঁর স্বপ্ন ছিল শিক্ষকতা করবেন আর একটি এমন স্কুল গঠন করবেন যেটা আদর্শ স্কুল হয়ে ওঠে। ছেলেবেলা থেকেই তাই হেডমাস্টার্স ম্যানুয়েল ঘাটাঘাটি শুরু করেন। আজ তিনি বলেন, স্বপ্ন অনেকটা পূরন হয়েছে কিন্তু আরও কাজ বাকি।এই করোনা পরিস্থিতিতে তাঁর স্কুলের ছাত্ররা অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস করছে কিনা খবর নিচ্ছেন তিনি। তাঁর ঘর ভর্তি পুরস্কার। উত্তর বঙ্গ আইকন থেকে আরও বহু বহু পুরস্কার। জাতীয় শিক্ষক পুরস্কার দেওয়ার জন্য তাঁর নাম এরাজ্য থেকে পাঠানো হয়েছে দিল্লীতে।দাদাগিরিতেও তাঁর ওপরে অনুষ্ঠান হয়েছে।