নিজস্ব সংবাদদাতা ঃ কফিন বন্দি বাবাকে দেখে কি ভাবছিল বছর পাঁচেকের মেয়েটি, তা কেউ জানে না । মায়ের কপালে যখন শেষ সিঁদুর পরানো চলছে , তখনও সে চুপচাপ । অঝোরে কাঁদছে তার মা , কাঁদছে দাদু-ঠাকুমা। শেষবারের মতো প্রিয় মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানাতে তখন চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। সকলের চোখেই বিদায়াশ্রু। আর ছোট্ট মেয়েটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে তার বাবার মুখের দিকে। তার বাবা, গালওয়াল উপত্যকায় চিনা সেনার আক্রমণে মৃত ভারতীয় সেনা বাহিনীর বীর শহিদ জওয়ান বিপুল রায় । দেশের গর্ব, শহিদ বিপুল রায়ের সারা শরীর ঢাকা তেরঙা জাতীয় পতাকায় । বাবা যে আর ফিরবে না, তা হয়তো এতক্ষণে বুঝতে পেরে গিয়েছে ছোট্ট মেয়েটি।
শুক্রবার আলিপুরদুয়ার জেলার বিন্দিপাড়া গ্রামে শহিদের শেষ বিদায় বেলায় এই দৃশ্যই কাঁদিয়েছে সকলকে। দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করা এলাকার সকলের প্রিয় ছেলেটির বিদায় শোকের সঙ্গে, চিরকালের মতো প্রিয়জন হারিয়ে যাওয়া, শহিদের পরিবারের শোক যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল সাঁঝ বেলার অন্ধকারে।
বৃহস্পতিবার রাতে লাদাখ সীমান্তের গালওয়াল উপত্যকায় চিনা সেনার আক্রমণে শহিদ হওয়া বিপুল রায়ের কফিনবন্দী দেহ এসে পৌঁছায় হাসিমারা বায়ুসেনা চত্বরে । শুক্রবার দুপুরে তাঁকে ‘গার্ড অফ অনার ‘ দেওয়া হয় বায়ুসেনার পক্ষ থেকে। শুক্রবার ঠিক সন্ধের আগে জাতীয় সড়ক ধরে তাঁর মরদেহ পৌঁছায় আলিপুরদুয়ার ভাটিবাড়ী সংলগ্ন বিন্দিপাড়ায়। শহিদের জন্মভূমি বিন্দিপাড়ায়, তখন পথের দুধারে অগণিত মানুষ তাদের প্রিয় বিপুলকে চোখের জলে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে হাজির। বিদায়াশ্রুর পাশাপাশি, জাতীয় পতাকা নেড়ে শেষ বিদায় জানানো হয়। পুষ্পার্ঘে জানানো হয় শেষ শ্রদ্ধা। রাজ্য সরকারের তরফে ‘গান স্যালুট’ জানানো হয় শহিদ বিপুল রায়কে ।
সেনা জওয়ানদের কাঁধে চড়েই শহিদের মরদেহ পৌঁছায় তার বসতবাড়িতে । বৃদ্ধ বাবা মা, আত্মীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী সহ অসংখ্য মানুষ হাজির তখন সেখান। কান্নায় ভেঙে পড়েন সকলেই । নিয়ম মেনে শেষবারের মতো সিঁথিতে সিঁদুর পরানো হয় স্ত্রী রুম্পাদেবীকে । এরপর শহিদের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় বাড়ির পাশের গদাধর নদীর ধারে ।
এদিন শহিদ বিপুল রায়ের শেষ বিদায়ে উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসনের তরফে জেলা শাসক, মহকুমা শাসক, পুলিশ সুপার সহ বহু আধিকারিক । রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে শহিদের শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সকলেই। ছিলেন কোচবিহারের বিজেপি সাংসদ নিশীথ প্রামানিক, আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বারলা, ছিলেন আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল বিধায়ক সৌরভ চক্রবর্তী, ছিলেন তৃণমূল জেলা সভাপতি মৃদুল গোস্বামী সহ বহু বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তি ।
পশ্চিমবঙ্গের দুই বীর সন্তান। শহিদ হয়েছেন বীরভূমের মহম্মদ বাজারের রাজেশ ওরাং ও আলিপুরদুয়ারের বিন্দিপাড়ার বিপুল রায়। দেশ খুইয়েছে মোট ২০ জন বীর সন্তানকে । পাঁচ বছরের ছোট্ট তামান্নার মতো আরও অনেক তামান্না হারিয়েছে তার প্রিয় মানুষটাকে। ইতিহাস মনে রাখবে বীর শহিদদের । আর ছোট্ট তামান্না’রা, তাদের প্রিয় মানুষটির আত্মবলিদানে উদ্বুদ্ধ হয়ে আবারও এগিয়ে আসবে, তাদের মত করে দেশ সেবায়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাজ্যের পক্ষ থেকে বিন্দিপাড়ায় শহীদ বিপুল রায়কে শেষ শ্রদ্ধা জানান পর্যটন মন্ত্রী গৌতম দেব।