বাপি ঘোষ, শিলিগুড়ি ঃদার্জিলিং ও কালিম্পং পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় স্বনির্ভরতার জন্য মিথুন প্রতিপালনের উৎসাহ দেওয়ার কাজে নেমেছে রাজ্য প্রশাসন। কালিম্পং ও দার্জিলিংয়ে এনিয়ে দুটি পর্যায়ে পরপর মেলবন্ধন সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ এগ্রিকালচারাল রিসার্চ এর অধীন ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অন মিথুন ছাড়াও রাজ্যের পশু পালন দপ্তর, কমপ্রিহেনসিভ এরিয়া ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বা সি এ ডি সি, জিটিএ এবং জেলা প্রশাসন মিলে গত ৩ মার্চও দার্জিলিংয়ে বৈঠক হয়েছে মিথুন প্রতিপালনের ওপর । গ্রামের কিছু উৎসাহী মানুষও তাতে উপস্থিত ছিলেন। স্থির হয়েছে, গ্রামের এইসব মানুষকে মিথুন প্রতিপালনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রশিক্ষন দেওয়া হবে। আর তারা প্রশিক্ষিত হলে তাদের মাধ্যমে আরও কিছু মানুষ স্বনির্ভর হয়ে সংসার প্রতিপালন করতে পারবেন।
মিথুন আসলে এক ধরনের গোজাতীয় প্রানী। এই প্রানী দেখতে গরুর মতো হলেও আসলে গরু নয়।এদের সঙ্গে ইন্ডিয়ান বাইসনের অনেকটা মিল দেখতে পান গবেষকরা। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো ছাড়াও চিনের কিছু প্রদেশ, বাংলাদেশের চট্টগ্রামে দেখা যায় মিথুন। গোটা পৃথিবীতে যত মিথুন রয়েছে তার ৯৮ শতাংশই রয়েছে ভারতে। ভারতে এখন এর সংখ্যা চার লাখের কিছু বেশি। আর সেই সংখ্যার ৮৯ শতাংশ রয়েছে অরুনাচল প্রদেশে। ২৫ হাজার রয়েছে নাগাল্যান্ডে, মনিপুরে দশ হাজার, মিজোরামে চারপাঁচ হাজার। অরুনাচল প্রদেশ এবং নাগাল্যান্ডে এই প্রানীটিকে তাদের রাজ্য প্রানী হিসাবে ঘোষনা করা হয়েছে।
মূলত এই প্রানীর মাংস বিক্রি করবার প্রবনতা ঘিরেই নাগাল্যান্ড, অরুনাচলে একসময় এর জনপ্রিয়তা ছিলো। কিন্ত ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অন মিথুন দিনের পর দিন গবেষণা চালিয়ে ঘোষণা করে, শুধু মাংস বিক্রি করাই নয়, আরও বহু কাজে উপকারে আসতে পারে মিথুন। মিথুনের দুধ খেতে পারে মানুষ। পুরুষ মিথুন চাষবাসের কাজে লাগানো যেতে পারে। মিথুনের চামড়া থেকে লেডিজ ব্যাগ, লেদার জ্যাকেট, জুতো প্রভৃতি জিনিস তৈরি করা যায়। মিথুনের দুগ্ধজাত অনেক সামগ্রীও তৈরি হয়।
ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অন মিথুনের অধিকর্তা ডঃঅভিজিৎ মিত্র তাঁর টিম নিয়ে মিথুনের ওপর গবেষণাধর্মী কাজ করে চলেছেন। ডঃ মিত্র জানালেন, আগে শুধু এর মাংসই খাওয়া হোত। তাদের গবেষণার পর এখন শুধু মাংসই নয়, বিভিন্ন কাজে আসছে মিথুন। নাগাল্যান্ড, অরুনাচল প্রদেশে কার বাড়িতে কত মিথুন আছে তার ওপর তার সামাজিক মর্যাদা গণ্য করা হয়। সেখানকার আদিবাসী উপজাতি এলাকায় মিথুন বেশ জনপ্রিয় একটি প্রাণী।
শোনা যায়, ১৯৬০ সালে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ইটানগর সফরে গেলে সেখানকার এক গ্রাম প্রধান প্রধানমন্ত্রীকে বলেই বসেন, আপনাকে ৫০০ মিথুন দেবো, আপনি আপনার মেয়ের বিয়ে দিন আমার ছেলের সঙ্গে! মিথুন সেখানে এতটাই সামাজিক মর্যাদা বহন করে যে, মিথুন যেন অনেকটা এটিএমের মতোনই। কারও মেয়ের বিয়েতে কন্যা পক্ষ বলেই বসে পাত্র পক্ষকে, আপনাকে মিথুনের সামনের একটি পা কেটে দেবো। অনেকে এটাকে সোনার চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করেন।
তবে এলাকার মানুষকে এখন বোঝানো হয়েছে যে, শুধু মাংস নয়, আরও বহু কাজে লাগতে পারে মিথুন। এর দুধে আট থেকে দশ শতাংশ ফ্যাট রয়েছে। মিথুনের দুধ কাজে লাগিয়ে লস্যি, দই, পনির, রসগোল্লাও হতে পারে। এবং সেসব কিছু কিছু হচ্ছেও। একটি মিথুন থেকে এক থেকে দেড় কেজি দুধ হতে পারে। এখন এইরকম প্রানীকে কাজে লাগিয়ে দার্জিলিং পাহাড়ের মানুষদের মধ্যেও বিরাট স্বনির্ভরতা হতে পারে। সেদিকে তাকিয়েই শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার অন মিথুন থেকে অভিজিৎবাবু সহ অন্যরা দার্জিলিং এসে ঘুরে গিয়েছেন। তারা জানাচ্ছেন, নাগাল্যান্ড, অরুনাচলের পাহাড়ি পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকায় দার্জিলিং পাহাড়ে এর বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। দার্জিলিং এর অতিরিক্ত জেলা শাসক বৈশাখি দে জানিয়েছেন, তারা আলোচনা, কর্মশালা শুরু করেছেন প্রাথমিক পর্যায়ে। তারা চাইছেন, পাহাড়ের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ মিথুন প্রতিপালনের মাধ্যমে স্বনির্ভর হয়ে উঠুক।