শিল্পী পালিত ঃ আজ আত্মকথায় দমদন পার্কের ভারতী সেনগুপ্তের কথা মেলে ধরা হচ্ছে —
বীণাপাণি শিল্পী আমাকে আবারও কলম ধরতে অনুরোধ জানিয়েছে, আমার সাংস্কৃতিক জীবন নিয়ে কিছু লেখার জন্য। সেভাবে সাংস্কৃতিক জীবনে আমি সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, গানের পরিবেশে আমি বড় হ’য়েছি। এ বিষয়ে বলতে গেলে আমার মা-বাবার কথা বলতেই হয়। আমার মা সুধা গুপ্তভায়া সেকালের বিখ্যাত গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে’র ছাত্ৰী ছিলেন। ওনার বাড়িতে গিয়ে গান শিখতেন।এটা আমার মায়ের পরম সৌভাগ্য। আমার বাবাও রজনীকান্ত সেনের কোলে বসে গান শিখেছেন। সে তুলনায় আমরা ভাই-বোনেরা তাঁদের কাছ থেকে কিছুই নিতে পারি নি। তবে মা চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা মায়ের কাছে হলেও মা আমাদের গানের স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন।
আমার জন্ম জলপাইগুড়িতে। সে সময় যাঁরা গানের শিক্ষক ছিলেন— নেপু বোস, তরু রায়কত, বাণীকন্ঠ— এনাদের সবার কাছেই গান শিখেছি। তাছাড়াও বিধাত্রী কাকুর কাছে কিছুদিন কীর্তন’ও শিখেছিলাম। গান ছাড়াও জাম্বা পালের কাছে সেতার ও বেহালা-দাদুর কাছে বেহালাও শিখেছিলাম।
আমার মা আমার মেজদির(তপতী) জন্য সেতার কিনেছিলেন। মেজদি সেতার হাতে নিয়ে ক্লাসে যেতে লজ্জা পেল। তখন আমি বললাম, আমি শিখবো। বেশ কয়েক বছর শিখেছিলাম। নিখিল-বঙ্গ কলা-প্রতিযোগীতায় জলপাইগুড়ির আর্য-নাট্য হলে(এখন রবীন্দ্র-ভবন) জৌনপুরী রাগে সেতার বাজিয়ে আমার বিভাগে প্রথম হয়েছিলাম। Judge হয়ে এসেছিলেন পন্ডিত বলরাম পাঠক। আমার গুরুজী জাম্বা পাল মারা যাবার পর নানা কারণে আর শেখা হয়ে ওঠে নি।
সেতার শেখার পাশাপাশি বেহালা বাজানোও শিখতে শুরু করেছিলাম। শুরুটা বেশ মজার। মায়ের ইচ্ছা হয়েছিল বেহালা শেখার। আমাদের বাড়িতে এক ভদ্রলোক আসতেন, বেহালা বাজাতেন। নামটা মনে করতে পারছি না। আমরা বেহালা-দাদু বলে ডাকতাম। মনের আনন্দে বেহালা কেনা হ’ল। দাদু মাকে শেখানো শুরু করলেন। আমি এক মনে বসে শেখানোটা দেখলাম। মা ঠিক আয়ত্তে আনতে পারছেন না। ডান হাত চলছে তো বাঁ হাত থেমে যাচ্ছে, বাঁ হাত চলছে তো ডান হাত থেমে যাচ্ছে। মা গলদঘর্ম হয়ে যন্ত্রটা নামিয়ে রেখে রান্না ঘরে চলে গেলেন। বেহালা-দাদুও সেদিনের মত বিদায় নিলেন। আমি আপন মনে বেহালা কাঁধে তুলে নিলাম। আশ্চর্যজনক ভাবে নির্ভুল সা-রে-গা-মা বাজিয়ে ফেললাম। রান্নাঘর থেকে শুনে মা ছুটে এলেন। আমি আবার বাজালাম। মা মুগ্ধ। পরদিন দাদু এলে মা ওনাকে বললেন ‘আপনি কলিকেই শেখান’। কিছুদিন শেখার পর মোটামুটি রপ্ত করে ফেলেছিলাম। যে কোন গানের সাথেও বাজাতে পারতাম। তারপর আস্তে আস্তে গান-বাজনা বন্ধ হয়ে গেল। শিশুনিকেতনে কয়েক বছর শিক্ষকতা করেছিলাম সেখানে বাচ্চাদের গান শেখাতে, নানা-রকম অনুষ্ঠান করানোতে খুব আনন্দ পেতাম।
বিয়ের পর সব ছেড়ে কোলকাতায় চলে আসা। একান্নবর্তী পরিবারে এসে গান-বাজনা নিয়ে আর এগোতে পারিনি। তবে আমার স্বামী অনুপম সেনগুপ্ত গান-বাজনার খুব ভালো শ্রোতা ও সমঝদার। কোনদিনও গান না শিখেও গান গাইতে পারতেন। আমার সাথে রবীন্দ্রসঙ্গীতেও গলা মেলাতেন। যে কোন রাগ-রাগিনীর সুর শুনে বলে দিতে পারতেন— কি রাগ।
আমার যখন ৬০ বছর বয়স, সল্টলেকে শরদিন্দু চন্দ বলে এক ভদ্রলোকের সাথে আমাদের পরিচয় হয়। উনি অসাধারণ বেহালা বাজান। শিশিরকণা ধরচৌধুরীর ছাত্র ছিলেন। আমার বেহালা শেখার ইচ্ছা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আমার মেয়ে সোহিনী আমাকে নতুন বেহালা কিনে দিল। আমি আবার সঠিক পদ্ধতিতে বেহালা শেখা শুরু করলাম। আমার স্বামীর উৎসাহ ছাড়া মধ্য বয়সে নতুন করে শেখা সম্ভব ছিল না। ৬/৭ বছর এক টানা শিখেছিলাম। চন্দদা আমাকে খুব উৎসাহ নিয়ে শেখাতেন। এরপর উনিও অসুস্থ হয়ে পরলেন, আমিও সল্টলেক থেকে দমদম-পার্কে চলে এলাম। চন্দদা গত বছর আমাদের মায়া কাটিয়ে পরলোকে চলে গেলেন। খুব উদার মনের মানুষ ছিলেন। আমাদের খুব স্নেহ করতেন।
আমার মেয়ের গানের প্রাথমিক শিক্ষাও আমার কাছে। পরে নাম করা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কমলা বসুর কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখেছিল। ডাক্তারী পেশায় যুক্ত থাকায় এখন আর গানে সময় দিতে পারে না। আমি নিশ্চিত শুধু গানটা নিয়ে থাকলে গানেই প্রতিষ্ঠালাভ করতে পারতো।
আমার এই সাধারণ সাংস্কৃতিক জীবন-ধারা অতি নগন্য। জীযন সায়াহ্নে এসে মনে বড় আক্ষেপ হয়— জীবনে কিছুই করতে পারলাম না। ভগবানের কাছে সব সময় প্রার্থনা করি— এ জন্মে কাঠামোটা তৈরী করতে পেরেছি। পর-জন্মে যেন প্লাটফর্মটা তৈরী করতে পারি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে চাই—-
“তোমার কাছে এ বর মাগি, মরণ হতে যেন জাগি গানের সুরে”।
Bharati Sengupta
354 Dum Dum Park
Flat No – 1 B
Kolkata 55