পল মৈত্র, দক্ষিন দিনাজপুরঃ কখনও হ্যারিকেন আবার কখনও হ্যাজাকের আলোতে অভিনয় করে মঞ্চ কাঁপিয়েছেন একসময়। সেসব দিন এখন এলিডি আলোর মতো স্মৃতিতে ভাসে।পুরনো স্মৃতির রোমন্থনে এসব কথাই বলছিলেন ওপার বাংলার দিনাজপুরের যাত্রা অভিনেতাজ্যোতিষ চন্দ্র দাস।
দেশভাগের যন্ত্রণা কাঁধে নিয়ে সাত বছর বয়সে বাবা মায়ের হাত ধরে দেশ ছাড়েন। তারপর থেকেই দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট ব্লকের সাওয়াই বানিয়াকুড়ি গ্রামে বাস শুরু। শৈশবের অনেক স্মৃতিই জড়িয়ে আছে এখানে। ইন্দ্রা প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষার পর বাউল পরমেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার পাঠ নেন। অভাব অনটনের সংসারে কলেজে পড়ার ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয়নি। বয়স ১৫, অভিনয়ের ‘অ’ টুকুও বোঝেননা তখন। পাড়ার যাত্রা দলে নাম লিখিয়েছেন সবে। ‘কবিচন্দ্রাবতী’ যাত্রাপালায় প্রহরীর অভিনয়ের জন্য অভিনেতার হদিস চলছিল। বছর পনেরোর লম্বাটে জ্যোতিষ সেদিন সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। ছোটো চরিত্র বলে পরিচালকও ভরসা করেছিল জ্যোতিষের প্রতি। ঘন্টা দুয়েক পরেই মঞ্চে ডাক পড়বে জ্যোতিষের। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে সে। মঞ্চে ওঠার ভয়ে, ফাঁক পেলেই ছলেবলে পালানোর ধান্দা খুঁজছে। যাত্রাটিমের কমিটির লোকেরা হাত ধরে আটকে রেখেছিল তাঁকে, যাতে ব্যাটা পালাতে না পারে। কথা বলতে বলতেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো আরও কত সব টুকরো স্মৃতি। তারপর থেকেই অভিনয় টাকে আপন করে নিয়েছিলেন নিজের কাছে। এরপর প্রসাদ কৃষ্ণ ভট্টাচার্য রচিত ‘লৌহকপাট’ যাত্রা পালায় বাসক চরিত্রে অভিনয় করেন। তারপর থেকেই সাওয়াই এর অপরুপ নাট্য সংসদের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে অভিনয় করতে যেতেন। খুনের জবাব সামাজিক যাত্রাপালা, দেবী সুলতানা, অচল পয়সা, ভৌরব গঙ্গোপাধ্যায় রচিত মা মাটি মানুষ , ব্রজের বাসুরী, সেলাই করা সংসার, কলির ধারা সহ বিভিন্ন যাত্রাপালায় অভিনয় করেন। অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে কাঁধে এসে পড়ে অপরুপ নাট্য সংসদ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব। প্রায় আশির দশক থেকে ১৬ জন সদস্যকে নিয়ে চালিয়ে আসছেন অপরুপ নাট্য সংসদ। বহুবার অভিনয় করতে গিয়ে প্রশংসিত হয়েছেন বিভিন্ন স্থানে। একসময় নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সময়ের কাঁটা অনেক গড়িয়েছে। বয়স বাড়ছে। যৌবনের সেই উচ্ছাস উদ্দিপনা আর নেই। বছর দুয়েক হল অভিনয় ছেড়ে দিয়েছেন। যাত্রাপালা করার জন্য ভালো অভিনেতাও অভাব এসময়। অনেকটা আক্ষেপের সুরেই বললেন, “অভিনয় করতে গেলে ঘর-সংসার ছাড়তে হতে পারে। এখনকার ছেলেমেয়েরাতো সামান্য মোবাইলটুকুকেই ইগনোর করতে পারে না। তাহলে অভিনয় শিখবে কি করে !” ৭২ বছর বয়সে এসেও বাংলার যাত্রাশিল্পকে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন দক্ষিণ দিনাজপুরের জ্যোতিষ চন্দ্র দাস।