টিকেন্দ্রজিৎ মুখার্জী,শিলিগুড়িঃ সকলকে দেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
সকলে ভালো থাকুন। আজ আমরা স্বাধীনতা দিবস পালন করছি বটে। কিন্তু এই স্বাধীনতা আমরা চাই নি। আমরা চেয়েছিলাম দেশ স্বাধীন হলে সবাই অন্তত মোটা ভাত, মোটা কাপড়ে থাকবে। কিন্তু এখনও বহু মানুষ খেতে পায় না। দেশে নারী নির্যাতন যেভাবে বেড়েছে তাতে আমাদের মন ভালো লাগছে না।
বয়স আমার ৯২ চলছে। অনেকদিন থেকে বাড়িতেই বন্দি। দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পাওয়ার পর বাড়িতে বন্দি কয়েকবছর ধরে। শিলিগুড়ি সারদা পল্লীতে আমার বাড়ি। ১৯২৬ সালের পয়লা জানুয়ারি বাংলাদেশের খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার বাসাবাড়ি গ্রামে আমার জন্ম। আমার বাবার নাম ললিত মোহন মুখার্জী। ১৯৪২ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনে আমি অংশ নিয়েছিলাম। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। অহিংস আন্দোলন করলেও গান্ধিজি যখন একবার বললেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য তোমরা যে যেভাবে পারো অংশ নাও, তখন আমরা কয়েকজন একটু জঙ্গি আন্দোলনে নামার কাজেও মনস্থির করি। যোগাযোগ হয় অনুশীলন পার্টির সঙ্গে। একবার স্থির হয় বোমা ফেলা হবে কয়েকটি স্থানে। তার সঙ্গে স্থির হয় বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে। আর আগুন দিয়ে বিভিন্ন সরকারি প্রতিস্থান জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। সেই হিসাবে আমার ওপর গোপন মিটিঙে ভার দেওয়া হয়, বাগেরহাট জেল খানা এবং রেল স্টেশনে বোমা ফেলতে হবে। আমি আমার এক বন্ধুকে নিয়ে বোমা আনতে ঢাকায় চলে গিয়েছিলাম। কখনও হেঁটে, কখনো ট্রেনে আমরা ঢাকায় যাই। এক রাত স্টেশনের প্ল্যাট ফর্মেও রাত কাটাই। তারপর অনুশীলন সমিতির কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সাতটি বোমা নিয়ে আসি। টিনের বাক্সে দেওয়া হয়েছিল বোমাগুলো। আমরা লুকিয়েচুরিয়ে ঢাকা থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে সেসব বাগেরহাটে নিয়ে আসি। এর মধ্যে একটি বোমা আমি ফেলতে পেরেছিলাম বাগেরহাট জেল খানায়। রেল স্টেশনে বোমা আর ফেলতে পারি নি। আমারই এক বন্ধু পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি করতো। সে আমায় পুলিশে ধরিয়ে দেয়। আমায় পুলিশে ধরিয়ে দিয়ে সেই বন্ধু বলেছিল, তোকে ধরিয়ে দিতে হল, কারন আমার চাকরিতে পদোন্নতি নিতে হবে। এভাবে অনেক বন্ধু বেশী শয়তান সেই সময় ইংরেজের দালালি করেছে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত মোট আড়াই বছর আমি জেলে ছিলাম। কখনও নে খেয়ে, কখনও মার খেয়েও আমরা পিছু হটে যাই নি। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, ইংরেজকে তাড়াতে হবে। কিছু জমিদারও সেই সময় ইংরেজের হয়ে দালালি করেছে। আমাদের গ্রামের এই রকম এক জমিদারকে একবার আমি পুলিশের সামনে মুখে থাপ্পর দিয়েছিলাম। বারবার আমরা বলেছি, বন্দেমাতরম। আজও বলছি, বন্দেমাতরম। দেশের সকলে ভালো থাকুন। দেশে মুল্যবোধ আরও বাড়ুক, দিকে দিকে মানবিক মুখের প্রকাশ ঘটুক। খবরের ঘণ্টাকে ধন্যবাদ আমার কথাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ায়। ( শিলিগুড়িতে এই সময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে একমাত্র বেঁচে আছেন টিকেন্দ্রজিৎ মুখার্জী। দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাতিলের কাছ থেকে তিনি সংবর্ধনা নিয়ে এসেছেন ২০০৮ সালে। তার কথা গুলো শুনে অনুলিখন করে দিয়েছেন পত্রিকা সম্পাদক বাপী ঘোষ।)