বাপি ঘোষ ঃ নমস্কার সকলকে, আমি বাপি ঘোষ, খবরের ঘন্টার সম্পাদক। দীর্ঘ ৩৪ বছরের সাংবাদিকতার জীবনে আজ ১১ আগস্ট ২০২৩, এক অভিজ্ঞতা শেয়ার না করে পারছি না। আমাদের নিউজ রিডার সোমা দাস ভয়েজটি দিচ্ছেন, আমি শুধু লিখছি মাত্র। আজকের ঘটনা মেলে ধরার আগে মাস দুই তিনেক আগের একটি ঘটনা মেলে ধরতে চাই।শিলিগুড়ি রবীন্দ্রনগর গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষিকা তথা বিশিষ্ট সমাজসেবী পৃথা সেন দু-তিন মাস আগে আমাকে একটি মানবিক আবেদন সম্পন্ন খবর পেলে ধরার কথা জানান। পৃথাদেবী বলেন, একজন বয়স্ক মহিলার কন্যা থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত, তিনি অত্যন্ত গরিব। বাড়ি ফুলবাড়িতে, তার জন্য খবরের মাধ্যমে যদি খবর করে কিছু সাহায্য সহযোগিতা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। আমি পৃথাদেবীর কথায় রবীন্দ্রনগর গার্লস হাইস্কুলের সামনে উপস্থিত হলে জানতে পারি, পৃথাদেবী ওই বৃদ্ধার অবস্থার কথা শুনে মাঝেমধ্যেই মানবিক কারণে অর্থ সাহায্য করেন। আমি বৃদ্ধার কাছ থেকে সব শুনে বিভিন্ন এনজিও যেমন এন্ড স্মাইলের নবকুমার বসাকের সঙ্গে কথা বলি। নবকুমারবাবুরা প্রতিমাসে বৃদ্ধাকে চাল ডাল তুলে দেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু আমি ওই বৃদ্ধার কাছে জানাই, খবর সম্প্রচার করার আগে আপনার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মেয়ের ছবি চাই। বৃদ্ধা বলেন, আমি ছবি তুলতে পারিনা, আর আমার কাছে মোবাইলও নেই। তখন আমি এবং পৃথাদেবী সেই বৃদ্ধাকে জানাই আপনার বাড়ির আশপাশের কারো কাছ থেকে মোবাইল নিয়ে মেয়ের ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানোর জন্য কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হলেও সেই ছবি সেই বৃদ্ধা না পাঠাতে পারায় আমার মনে সন্দেহ হয়। আমি খবরটি পোস্ট না করে আটকে রাখি এবং পৃথাদেবীকে জানাই, বৃদ্ধা সত্যি কথা বলছে কিনা। কেননা কিছু মানুষ বা ভিখারিনী এমন আছে যারা নানা রকম মিথ্যা কথা বলে মানুষের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করে। এরপর খবরটি আটকে রেখে পৃথাদেবীকে জানাই, ওই বৃদ্ধা আবারো যদি কখনো আপনার কাছে এসে থাকে তাহলে আপনি আমাকে খবর দেবে। ১১ ই আগস্ট শুক্রবার সেই বৃদ্ধা হঠাৎ সকালবেলা পৃথাদেবীর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে জানায়, তার মেয়েকে বেঙ্গালুরু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চিকিৎসার জন্য। স্থানীয় ক্লাবের ছেলেমেয়েরা অর্থ সংগ্রহ করছে অর্থাৎ কিনা ঘুরিয়ে সেই বৃদ্ধা পৃথাদেবীর কাছ থেকে নতুন কৌশলে কিছু টাকা আদায় করা যায় কিনা তার পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। আমি এদিন সকালে পৃথাদেবীর কাছ থেকে খবর পেয়ে রবীন্দ্রনগর গার্লস স্কুলের কাছে পৌঁছাই এবং স্থির করি, সেই বৃদ্ধার সঙ্গে তার বাড়ি পর্যন্ত যাব এবং থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত তার মেয়ের ছবি তুলবো। যদি ঘটনা সত্যি হয় তবে নিশ্চয়ই মানবিক কারণে সকলের কাছে বৃদ্ধাকে সাহায্যের জন্য আবেদন জানাবো পৃথাদেবী একটি টোটো রিজার্ভ করে দেন। আর আমি স্কুটি নিয়ে রওনা দিই। রওনা দেওয়ার আগে বৃদ্ধা আমাদের জানায়,তার বাড়ি ফুলবাড়ীর সুভাষ পল্লিতে। সেখানে তার থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত মেয়ে আছে। আমরা রওনা দিলে বৃদ্ধা মাঝ রাস্তায় টোটো চালককে বারবার বলতে থাকেন, তুমি চলে যাও –আমাকে নামিয়ে দাও, অন্য একদিন আমার বাড়ি দেখিয়ে দিব। কিন্তু টোটো চালক জানান, পৃথাদেবীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে যে তোমার বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য এবং পৃথাদেবী এর জন্য আমাকে ভাড়াও দিয়েছেন। আমি তিন বাতি মোড়ে দীর্ঘক্ষণ স্কুটি নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকি, আর টোটো চালককে বলতে থাকি –সেই বৃদ্ধাকে নিয়ে আসুন তাড়াতাড়ি। টোটো চালক জানাতে থাকেন, বৃদ্ধা টোটো থেকে নেমে যেতে চাইছে। আমি টোটো চালককে বলতে থাকি যে, না, একদম নয়– বৃদ্ধাকে টোটো থেকে নামতে দেবেন না। এরপর সেই টোটো চালক তিন বাত্তি মোরে সেই বৃদ্ধাকে নিয়ে পৌঁছালে আমি তাদের বলি, আপনারা সামনে চলুন— আমি পিছনে আছি।বৃদ্ধাকে বলি, তুমি তোমার বাড়ি ফুলবাড়ীতে কোথায় দেখিয়ে দাও —আমি পিছন পিছন যাচ্ছি, তোমার মেয়ের ছবি তুলব। এরপর ডাবগ্রাম পুলিশ ব্যারাকের বিপরীত দিকে চলে যাওয়া রাস্তায় সে বৃদ্ধা তাঁর বাড়ির পথ দেখান আর বলেন, এদিকেই এদিকে আমার বাড়ি কিন্তু বৃদ্ধার চোখে মুখে এ কাচুমাচু শুকনো এক ভাব দেখা যায়। এই রাস্তা সেই রাস্তায়, অলিগলিতে সেই বৃদ্ধা আমাদের নিয়ে ঘোরাতে থাকে। কিন্তু তার বাড়ি দেখাতে পারেনা। শেষে পশ্চিম ধানতলার এক বাড়িতে ঢুকে সেই বাড়ির এক মেয়েকে বলতে থাকে কানে কানে– এই লোকগুলো যে আসছে, এদেরকে তুমি একটু বলে দাও –এটাই আমার বাড়ি। সেই কলেজ ছাত্রী মেয়েটি ভর দুপুরে আচমকা বাড়ির মধ্যে অচেনা অজানা বৃদ্ধার কাছ এরকম প্রস্তাব শুনে অবাক হয়ে যায় এবং বলে, তা কেন হবে? ইতিমধ্যে আমি সেখানে পৌঁছে যাই এবং সব ঘটনা সেই মেয়েটিকে জানাই।মেয়েটির বাবা তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন, তিনি ভাত মেখে রাখা অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে আসেন। বৃদ্ধাকে দেখে বলেন, নাতো, এনাকে চিনি না– কোনদিন দেখিনি। আর সেই কলেজ ছাত্রী মেয়েটি মিটমিট করে হাসতে থাকে বৃদ্ধার কান্ড দেখে। ইতিমধ্যে আশপাশের মহিলারা সেখানে জড়ো হলে বৃদ্ধা উধাও হয়ে যায়। তখন আমি এবং টোটো চালক মিলে আশপাশে খুঁজতে থাকি সে বৃদ্ধা কোথায় পালিয়ে গেল? আমি এই বাড়ি সেই বাড়ি ঢুকে জিজ্ঞেস করতে থাকি— কোনও বৃদ্ধা আপনাদের বাড়িতে এসেছে কিনা। কিন্তু সবাই জানায় যে –না, কোন বৃদ্ধাকে আমরা দেখিনি । শেষে আমি একটু হতাশ হয়ে ভাবলাম ফিরে আসি। সেখান থেকে শিক্ষিকা পৃথাদেবীকে ফোনে জানালাম সে বৃদ্ধা পালিয়ে গেছে। এই বলে টোটো চালককে বিদায় জানিয়ে আমিও যখন সেখান থেকে বিদায় নেব তখন একটি বাড়ির পিছনে সরু গলি দেখে আমার মনে একটু সন্দেহ হল, আমার মন বলল– সেই বৃদ্ধা এই বাড়ির পিছনে কোথাও লুকিয়ে নেই তো? যেমন ভাবা তেমন কাজ। আমি জলকাদা নোংরা পেরিয়ে সেই বাড়ির পিছনে পৌঁছে দেখি– অবাক কান্ড!!! সেই বাড়ির শৌচাগারের পাইপের কোনায় সেই বৃদ্ধা লুকিয়ে রয়েছে। আমি চিৎকার করতেই সেই বৃদ্ধা আমায় বলতে থাকেন, আমি পটি করছি। কিন্তু পটি বা শৌচ কর্ম করার কোন লক্ষণ দেখলাম না। তবুও আমি সেখান থেকে সরে এসে জমায়েত হওয়া অন্যান্য মহিলাদের বললাম, আপনারা একটু সহযোগিতা করুন। তারা সেই গলি দিয়ে গিয়ে বৃদ্ধাকে ধরে আনলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি পালিয়ে গেলে কেন? বৃদ্ধা জানালেন –না আমি পালিয়ে যাইনি— আমার পটি চেপেছিল, তাই এই বাড়ির পিছনে গিয়েছিলাম । আর সেই কথা শুনে সেই বাড়ির মালকিন তেড়েএলেন এবং বললেন, আমার বাড়িতে হঠাৎ করে তুমি পটি করছো? বৃদ্ধা জানালো, সামান্য একটু, দুই ফোটা। এরপর সবাই মিলে বৃদ্ধার বাড়ি জানতে চাইলে বৃদ্ধা আবার পাশের একটি গলির কথা জানালো। সেই মহিলারা সবাই মিলে আমার সঙ্গে হেঁটে হেঁটে সেই বাড়িতে গেলে সেই বাড়ির মহিলাকে আবার কানে করে ফিসফিস করে কি যেন বললেন সেই বৃদ্ধা। যদিও সেই মহিলা স্পষ্ট জানালেন, এই বৃদ্ধা এখানে থাকেনা— এটা তার বাড়ি নয়। আর বাড়ি জলপাইগুড়ির এক গ্রামে, বৃদ্ধার এক মেয়ে –সেই মেয়ে অসুস্থ কিনা তাঁর জানা নেই। এরপর রহস্য বেরিয়ে আসে যে সেই বৃদ্ধা মিথ্যা কথা বলছে। আমি হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কলে পৃথাদেবীর সঙ্গে স্থানীয় মহিলাদের কথা বলিয়ে দেই। পৃথা দেবী আমাকে রওনা দেওয়ার সময় পকেটে ৫০০ টাকা দিয়ে বলেছিলেন, যদি বৃদ্ধা সত্যি কথা বলে তবে তার হাতে ৫০০ টাকা আপনি দিয়ে দিবেন। কিন্তু বৃদ্ধা মিথ্যা কথা বলেছে বুঝতে পেরে আমি সেই ৫০০ টাকা বৃদ্ধার হাতে দেইনি কিন্তু বয়স্ক মানুষ বলে তাকে ছেড়ে দিই। সেই সঙ্গে জানাই যে তুমি অভাবী বা গরিব হলে পরিষ্কার অভাবের কথা বলে মানুষের থেকে সাহায্য নাও বা কোনো কাজ করো কিন্তু তোমার বাড়ি ফুলবাড়ী, মেয়ে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত —এরকম মিথ্যা কথা বলে মানুষের ভালো মানুষির কাছ থেকে টাকা তোলা ঠিক নয়। এরপর বৃদ্ধাকে সেখানে আমরা ছেড়ে দিই। স্থানীয় মহিলারা বলতে থাকেন– এই ধরনের কিছু মানুষ আছে বা ভিখারি আছে যারা মিথ্যা কথা বলে লোকের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা সংগ্রহ করে. কাজেই এই বিষয়ে সকলকে সচেতন থাকা দরকার। পরবর্তীতে পৃথাদেবী বলেন, অসহায় দুঃস্থ মানুষকে নিশ্চয়ই আমরা সাহায্য করব কিন্তু কেউ মিথ্যা কথা বলে টাকা তুলছে কিনা সেটাও যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন। এই বিষয়ে সকলকে সচেতন করেছেন পৃথাদেবী।।
বিস্তারিত জানতে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন —–