বাপি ঘোষঃ করোনা দুর্যোগে আক্রান্ত গোটা বিশ্ব। ভারতবর্ষও তার বাইরে নয়। এই দুর্যোগে বিরাট ভূমিকা চিকিৎসকদের। এই সময় লন্ডন হাসপাতাল ও তার আশপাশে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও জ্বরে আক্রান্ত বিভিন্ন মানুষজনকে চিকিৎসা সেবা দিয়ে চলেছেন কলকাতার দুই ভাই ও তাঁদের স্ত্রীরা। আর কলকাতা থেকে দুই পুত্র সন্তান ও পুত্র বধূ চিকিৎসকদের ফোন করে বারবার এই সঙ্কটে আরও বেশি করে মানবতার সেবা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডাঃ মুকুন্দ মজুমদার। বাবার কথামতো সন্তানেরাও মানুষের সেবার ব্রত নিয়ে দিনরাত এক করে চলেছেন। কলকাতা থেকে ফোনে ডাক্তার মুকুন্দ মজুমদার খবরের ঘন্টাকে জানালেন তাঁর বহু কথা। আসুন সেসব পড়া যাক —
” আমার বড় ছেলে সুব্রত মজুমদার একজন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ। বড় পুত্র বধূ ডাঃ শঙ্করী চক্রবর্তী ওরফে মজুমদার এফ আর সি এস পাশ, জেনারেল মেডিসিনের ডাক্তার। ছোট ছেলে ডাঃ দেবব্রত মজুমদার গ্যাসটোএনট্রোলজিস্ট, সে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার। ছোট পুত্র বধূ ডাঃ সাথি মুখার্জী এফ আর সি এস পাশ, তাছাড়া বেশ কয়েকটি ওষুধ সংস্থার ডিরেক্টর। ওরা অনেকদিন ধরে লন্ডনে রয়েছে চিকিৎসা পরিষেবায়। এখন ওদের কাজে পরিশ্রম এবং ঝুঁকি আরও বেড়েছে। একেবারে ফ্রন্ট লাইনে গিয়ে ওরা ঝুঁকি নিয়েই এখন রোগী দেখছে। একদিন পর পর ওদের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। ওদের কাছে শুনেছি, লন্ডন হাসপাতালে অন্য সময় যত রোগী থাকে এখন তার থেকে রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। জ্বর, সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত রোগী প্রচুর আসছে। তার মধ্যে কত যে করোনা পজিটিভ কে জানে! খোদ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী আই সি ইউতে চলে গিয়েছেন। এই অবস্থায় আমার পুত্র এবং পুত্র বধূরা সকলেই কাজে নেমেছেন। মানবতার ধর্মকে বড় করে সামনে রেখেই ওরা কাজ করছে। আমিও ওদেরকে এইসময় আরও বেশি বেশি করে মানবতার ধর্ম মেনে চিকিৎসা পরিষেবা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। তবে অবশ্যই নিজেকে রক্ষা করে বা সতর্কতা মেনেই কাজ করার কথা বলছি। ওরা সব প্রোটেক্টিভ মেজার নিয়েই কাজ করছে।
বড় ঘরে আমার এক নাতনি। ছোট ঘরে দুই নাতি। ওরা সপ্তম অষ্টম শ্রেনীতে পড়ে। এইসময় ওরা ঘর বন্দি। স্কুল বন্ধ থাকলেও ওরা অন লাইনে সব পড়াশোনা করছে।
এখন আমার বয়স আশি হয়েছে। জীবনে এইরকম করোনার মতো দুর্যোগ দেখিনি। করোনার মতো না হলেও ছোট বেলায় স্মল পক্স, কলেরা মহামারী দেখেছি। স্মল পক্সে প্রচুর লোক মারা যেতো। একেকটি বাড়ি থেকে দুতিনটি করে মৃতদেহ বেরিয়ে আসতো। আমার দেশের বাড়ি ছিলো ঢাকায়। বাবার নাম স্বর্গীয় শীতল চন্দ্র মজুমদার। বাবা ছিলেন আইনজীবী। খুব সাহস ছিলো বাবার। বাবা সামাজিক কাজ করতে ভালোবাসতেন। তাছাড়া বাবা ছিলেন সঙ্গীতজ্ঞ। খুব সুন্দর গান গাইতেন। যারা গানবাজনা করেন তাদের মনে হয় ভিতর থেকে একটা কাজ করার বাড়তি স্পৃহা আসে। বাবাকে দেখেতো অন্তত তেমনটা মনে হোত। কলেরা, বসন্তের মহামারীর সময়ও বাবা গুনগুন করে গাইতে গাইতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেন। সবাই ঘর বন্দি অথচ বাবা এই গ্রাম সেই গ্রামে সাহস করে ঘুরতেন। স্রেফ সেবার জন্য। যদি তাঁর সেবায় সমাজের কোনও কাজ হয়, কোনও অসুস্থ ভালো হয়। কত বড় সাহস থাকলে তখনকার দিনে কলেরা, বসন্ত মহামারীর সময় বাড়ির বাইরে থেকে সেবামূলক কাজ করা যায়! আজ আমি যে ডাক্তারি করি, সেবা করি কিংবা বাংলা ভাষা নিয়ে যে আন্দোলন করি সেসবের সাহস কিন্তু শুরুতে গেঁথে দিয়েছিলেন বাবাই। মা-ও মানুষের সেবা করতে ভালোবাসতেন। তাই আমার বাবামা আমার কাছে সবসময় বেঁচে আছেন। বাবাকে দেখতাম, বাড়ির বাইরে কলেরা রোগীর সেবা করে এসে ঘরে প্রবেশের আগে সব জামাকাপড় বাইরে রেখে দিতেন আলাদাভাবে। তারপর স্নান সেরে মুখে একটা পান গুঁজে নতুন জামাকাপড় পড়ে আবার বের হতেন সামাজিক সেবায়। কাছে চলে যেতেন যক্ষ্মা রোগীর সামনেও। কি অসম্ভব মনের শক্তি! আজ করোনা দুর্যোগ এর সময় সেই সব পুরনো দিন স্মরন করছি এই কারনে যে পুরনো সেসব ঘটনা বা দিন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
আজ করোনা নিয়ে এটাই বলবো, সচেতনতাই একমাত্র ওষুধ। কারও সংস্পর্শে আসা যাবে না। ঘর বন্দি থাকাই ভালো। হাত না ধুয়ে নাকেমুখেচোখে হাত দেওয়া যাবে না। হাতের মধ্যেই বেশি থাকে করোনা ভাইরাস। হাত যদি বারবার সাবান দিয়ে না ধুয়ে চোখে দেনতো তবে ভাইরাস নেত্র নালির মধ্যে দিয়ে নাক হয়ে ফুসফুসে চলে যাবে। আর ফুসফুসে গেলেই বিপত্তি। তাই লকডাউন সফল করতে হবে।
সামনে পয়লা বৈশাখ। এবারে আমার মতে পয়লা বৈশাখের জমায়েত বা অনুষ্ঠান পুজো না করাই ভালো। সবাই ঘরে থেকে মনে মনে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করাই ভালো। ঘরে বন্দি থেকে সবাই সোস্যাল মিডিয়ায় শুভেচ্ছা জানাতে পারেন। গুজব বা আতঙ্ক না ছড়িয়ে এই সময় সোস্যাল মিডিয়া বেঁচে থাকার বড় রসদ হতে পারে। করোনার বিরুদ্ধে সকলকে এক মহৎ ভাবনা নিয়ে কাজ করতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার শৃঙ্খলা না মানলে করোনা তার চক্র দ্বিগুন, তিনগুন, চার গুন আকারে ছড়িয়ে আমাদের সকলকে গ্রাস করবে। তাই সাবধান। সবাই ভালো থাকুন। সকলকে আমাদের বাংলা ও বাংলা ভাষা বাঁচাও কমিটি থেকে নববর্ষের আগাম শুভেচ্ছা। আসছে বছর এই দুর্যোগ কাটিয়ে যাতে আমরা সবাই আরও ঐক্যবদ্ধভাবে পয়লা বৈশাখ পালন করতে পারি তারজন্য রইলো প্রার্থনা। ”