বাপি ঘোষ,শিলিগুড়িঃঃঃপ্রভিডেন্ট ফান্ড দপ্তর থেকে অবসর গ্রহন করেছেন ৬৩ বছর বয়স্ক আশিস কুমার সরকার। ছেলে বাইরে থাকেন।বাড়িতে তারা বুড়োবুড়ি দুজন। বছরখানেক আগেও প্রায়ই আত্মহত্যার কথা চিন্তা করতেন আশিসবাবু। অবসাদ তাকে ভালোভাবেই গ্রাস করে।কিন্তু হঠাৎ একদিন ভাবেন, গান শিখবেন।যেমন ভাবা তেমন কাজ।যোগাযোগ করেন শিলিগুড়ি সারদাপল্লীর সঙ্গীত শিক্ষক স্বপন দে-র সঙ্গে।প্রথমে সারেগামাপাধানিসা,তারপর হালকা একটু ক্ল্যাসিক্যাল।তারপর রোজ সঙ্গীত চর্চা।কখন যে মাথা থেকে আত্মহত্যার চিন্তা দূরে চলে গেছে,তা নিজেও জানেন না তিনি।নিজেই সব জানালেন আশিসবাবু। বললেন,স্বপন দে আমার থেকে বয়সে ছোট হলেও আমার সঙ্গীত শিক্ষার গুরু। এখন বেশ ভালো আছি।এভাবেই আজব এবং রোমাঞ্চকর সব কান্ডকারখানা ঘটে চলেছে শিলিগুড়ি সারদা পল্লীর সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সপ্তকসঙ্গীত একাডেমিতে।যার মূল কান্ডারি সঙ্গীত শিক্ষক তথা শিল্পী স্বপন দে। আশিসবাবুর সঙ্গে সঙ্গে স্বপন কুমার রাহা,শুক্লা সাহার মতো ১৬ জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এখন সেখানে নিয়মিত সঙ্গীত শিখছেন।তাদের কেউ শারীরিক,কেউ মানসিকভাবে ভালো থাকবেন বলেই এই বুড়ো বয়সে সঙ্গীত চর্চার তালিমে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করেছেন।
আবার উত্তরবঙ্গবিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর স্তরের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী প্রকৃতি বৈরাগী, ছাত্রী শুক্লা সাহা,দেবিকা,দীপান্বিতা,চৈতালি সাহা,অরিত্র বৈরাগী,সন্দীপা মজুমদার,প্রীতিলতা বালো এরা সকলেই নতুন প্রজন্মের মেয়ে।তারাও স্বপনবাবুর কাছে দিনরাত ক্ল্যাসিক্যাল,রবীন্দ্র- নজরুলে মেতে থাকছেন।প্রকৃতি বলেন,আমিতো ক্লাস পরীক্ষার আগের দিনও সঙ্গীত চর্চা করেছি এবং করি।তাতে মন ভালো থাকে।সুস্থ সঙ্গীত চর্চা পরিবেশও ভালো রাখে।রবীন্দ্র ভারতীর ছাত্রী শুক্লা বলেন,পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি সঙ্গীত চর্চা চালানো প্রয়োজন।আমিতো ফেসবুক করার সঙ্গে সঙ্গে গান করি।সঙ্গীত মনকে ফুরফুরে রাখে।টেনশন বা অবসাদ প্রবেশ করতে দেয় না। এভাবেই শিলিগুড়ি সারদা পল্লী এলাকায় সঙ্গীত চর্চার সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছেন স্বপনবাবু।
ছোট থেকেই স্বপনবাবুর কাছে গানই হল এক নেশা।প্রথমে আকাশবানীর গান শুনে তার অনুরাগ জন্মে সঙ্গীতের প্রতি। একসময় মিলন পল্লীর হাউজিংয়ে অন্যের বাড়িতে গিয়ে হারমোনিয়াম ধরা।সারেগামা না শিখেও গান শুনে গান গাওয়ার নেশা দেখে তাকে আবিস্কার করেন শিল্পী সত্যেন দাস।তার কাছে প্রথমে সঙ্গীত শিখে পরে প্রনব ভট্টাচার্য,দুলাল সুর চৌধুরির কাছে কিছুদিন গান শেখা। একসময় পেশার জন্য স্বপনবাবু খুললেন দুটি ফার্নিচারের দোকান।কিন্তু সে দোকান করতে গিয়ে সঙ্গীত চর্চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে রাতারাতি দোকান বন্ধ করে দেন।পুরোপুরি প্রবেশ করেন সঙ্গীত চর্চায়।সঙ্গীতই হয়ে দাঁড়ায় তার নেশা ও পেশা।মাত্র দুতিনজন ছাত্র নিয়ে শুরু করেন সপ্তকসঙ্গীত। আজ তার ছাত্রছাত্রী সংখ্যা দেড়শ জন। একসময় বাড়ি বাড়ি সাইকেল নিয়ে গিয়ে সঙ্গীত শেখাতেন।আজ তার সে লড়াই অন্য মাত্রায় পৌচেছে। গতবছরই সুরভারতী সঙ্গীত কলাকেন্দ্র তাকে সংস্কৃতি বিশারদ এবং বিশিষ্ট সংস্কৃতি ব্যক্তিত্ব হিসাবে সংর্বধনা দিয়েছে।স্বামী বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক বেলুড় মঠে গিয়ে তিনি গনেশ বন্দনা ও দুর্গা স্তুতি পরিবেশন করে এসেছেন।শিলিগুড়ি থেকে পঞ্চাশ জন ছাত্রীকে ট্রেনে চাপিয়ে বেলুড়ে অনুষ্ঠান করে এসে তিনি বিভিন্ন মহলে দাগ কেটেছেন। সম্প্রতি শিলিগুড়ি তথ্য কেন্দ্রে সুরভারতি সঙ্গীত কলা কেন্দ্রের এক অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত সঙ্গীত গুরু পন্ডিত সঞ্জয় বালচন্দ্র পাটকি এলে তার সামনে ৬০ জন ছাত্রীকে এক যোগে হাজির করে সরস্বতী বন্দনা এবং দুর্গা স্তুতি পরিবেশনের মাধ্যমে বেশ প্রশংসা অর্জন করেন স্বপনবাবু।তাকে তার এই কাজে তার স্ত্রী সুমিতা এবং ছেলে দেবজ্যোতি বেশ সহযোগিতা করেন।স্বপনবাবু বলেন,আজ চারদিকে যে অসুস্থতা চলছে সেখানে সঙ্গীতই পারে সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে। সঙ্গীত পারে মানুষের মস্তিস্কের সুস্থ বিকাশ ঘটাতে। আর স্বপনবাবু বুড়ো থেকে নতুনদের মধ্যে দিনরাত সঙ্গীত চর্চার নেশায় মত্ত। তিনি বলেন,চিরকাল কেউ বাঁচে না।কিন্ত একটা দাগ রেখে যেতে চাই।তাই সাধনা চলছে।আমি কোনওদিন না থাকলেও বেঁচে থাকতে চাই এইসব ছাত্রদের মধ্যেই।