বাপি ঘোষ ঃ করোনা দুর্যোগের জেরে যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বা হতে চলেছে তার জন্য সরকারকে বাজারে টাকার যোগান বাড়াতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা মাইক্রো স্মল মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজেসের অধীন ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগীদের জন্য এখন সরকারকে সাহায্য করতে হবে। নইলে দেশের হাজার হাজার ছোট ব্যবসায়ী বা ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগী কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এরজন্য সরকারকে প্রয়োজন হলে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, অন্য দেশ বা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এমনকি জনগনের কাছ থেকে অর্থ ঋন নিতে হবে। বুধবার খবরের ঘন্টার কাছে এই অভিমত জানালেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ডঃ কনক কান্তি বাগচি। করোনা দুর্যোগ ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে তিনি আরও অনেক মূল্যবান মতামত জানালেন, আসুন তাঁর অভিমত বা কথাবার্তা একটু পড়ে নিই—
“করোনার এই বিপর্যয় নিশ্চয়ই কাটবে। তবে কবে কাটবে বা করোনা কবে বিদায় নেবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে এখন এই লকডাউনে সব কাজকর্ম বন্ধ। ব্যবসাবাণিজ্য, কলকারখানা সব বন্ধ। ক্ষেতখামারে কিছু কাজ হলেও তা তেমন নয়। পরিযায়ী শ্রমিক, যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের অবস্থা খুব খারাপ। এরা সবাই সরকারি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। যদিও বহু মানুষ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, কেও ব্যক্তিগতভাবে এইসব দিনমজুর শ্রমিকদের জন্য ত্রানের ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু সেটা কতদিন চলবে,সেটাও একটি বিষয়।
কেন্দ্র সরকার এক লক্ষ ৭০ হাজার কোটি টাকা ত্রানের ঘোষণা করেছে। সেই সব ত্রান পৌঁছাতেও শুরু করেছে। আগামীতে নিশ্চয়ই সরকার আরও দেবে। যদি ধরে নিই লকডাউন বাড়বে না, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে, তাহলেও যে ত্রান সরকার ঘোষণা করেছে, বলবো,তা কিন্তু যথেষ্ট নয়। আরও সমপরিমাণ ত্রান ঘোষণা করা দরকার। নাহলে এই জনমজুর দরিদ্র মানুষগুলোকে রক্ষা করা যাবে না। আর এদের রক্ষা করা বা বাঁচিয়ে রাখা কল্যানকারী রাষ্ট্রের প্রাথমিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যদিও কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার উভয় সরকারই চেষ্টা করছে এইসব গরিবদের ভালো রাখার জন্য। এখন যদি লকডাউন বাড়ে তবে কিন্তু প্যাকেজও বাড়ানো দরকার।
যদিও সরকারইবা কতটা প্যাকেজ বাড়াতে পারবে। কেননা, সরকারেরও একটা সীমা আছে। তবে আশা করা যায়, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে।
কিন্তু এই লকডাউনের জেরে যে আর্থিক ব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়েছে তা মেরামত করতে হবে সরকারকেই। টাকার যোগান বাড়াতে হবে বাজারে। অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন বা অর্থনীতি চাঙ্গা করতে হলে সরকারকে আরও টাকা ঢালতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কথা ভাবতে হবে। বৃহৎ ব্যবসায়ীদের যা ক্ষমতা আছে তাতে তারা চালিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা মাইক্রো স্মল মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ এর ক্ষুদ্র বা অতি ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগীদের কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো মুশকিল হবে। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকার এইসব এম এস এম ই প্রকল্পের ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগীদর স্বনির্ভরতার জন্য নানা পরিকল্পনা নিয়ে কাজতো করেই যাচ্ছিলো। এখন এদেরকে আর্থিক সাহায্য না করলে এরা কিন্তু ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
সরকার এখন পর্যন্ত যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা বি পি এলদের জন্য। কিন্তু যারা বি পি এল নয়, বি পি এলের কাছাকাছি, সেই ক্ষুদ্র, অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা শিল্পোদ্যোগীদের জন্য এবার সহায়তা বাড়ানো দরকার। এখন এখানে তর্ক বা প্রশ্ন আসতে পারে, সেটা হলো জীবন আগে বাঁচাতে হবে নাকি অর্থনীতি। আমি বলবো, দুটোই দেখতে হবে। তবে হ্যাঁ, জীবন আগে, অর্থনীতি সেকেন্ডারি।
অর্থনীতির ভাষায় বিজনেস সাইকেল বলে একটা জিনিস আছে। কখনও বাজারে অর্থনীতি বেশ চাঙ্গা থাকে। ব্যবসায় একটা বুম থাকে। কখনও আবার বাজার মন্দা হয়। সাইকেলটা ওঠানামা করে। রিসেশন হয়। কিন্তু এই করোনা আর লকডাউনের জেরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা কিন্তু অস্বাভাবিক। একটা বড়রকমের বিপর্যয় ঘটেছে। এই বিপর্যয় কাটাতে কিন্তু সরকারকে প্রচুর পরিমানে খরচ করতে হবে। দরকার হলে সরকারকে ঋনও নিতে হবে। অন্য দেশ, বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা আই এম এফ কিংবা এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এমনকি জনগনের কাছ থেকেও সরকারকে টাকা ঋন নিতে হবে। অর্থনীতি চাঙ্গা করা এবং মানুষ বাঁচাতে হলে সরকারকে এটা করতেই হবে।
অন্য অর্থনীতির সঙ্গে এবারের এই করোনা বিপর্যয়ের অর্থনীতি মেলালে চলবে না। খরা, বন্যা, ভূমিকম্পের জেরে যেটা হয় সেটা আলাদা। করোনা বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে কিন্তু একটা থ্রেট কাজ করছে। তাই এই বিপর্যয়ে সরকারকেও কার্পণ্য করলে চলবে না। একটা ভালো দিক হলো, বহু মানুষের মধ্যে এখন সমাজসচেতনতামূলক ভাবনা কাজ করছে। কাজেই সরকারও যদি এখন ঋন নিয়ে বাজারে টাকার যোগানের ব্যবস্থা করে কেও কিছু মনে করবে না। আর সরকারের কাছে সেই খরচ করার সুযোগও আছে। আশা করা যায়, সরকার তা করবেও।
১৯৪৩ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল যা বাংলাতে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। বহু লোক সেই সময় মারা যায়। তা নিয়ে আমি একটি গবেষনা করে লিখেওছিলাম। সেই বিপর্যয় অন্যরকম ছিলো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। এখন একটি দেশের জন্য আর একটি দেশ এগিয়ে আসে। এই যে দেখুন না, এবারে আমেরিকার মতো ধনী ও উন্নত দেশও হাইড্রোক্সিক্লোরোক্যুইনের জন্য ভারতের কাছে সাহায্য চাইলো। ভারতও শেষে তা রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলো। একটি উন্নত দেশ একটি উন্নয়নশীল দেশের কাছে সাহায্য চাইছে, ভাবা যায় না। এখন যদি সব দেশ একসঙ্গে কাজ করে, যেসব দেশ একটু কম ক্ষতিগ্রস্ত, তারা যদি অন্য দেশকে সাহায্য করে তাহলেও সবাই একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। আর তাতে সবার পরিত্রানের সুবিধা হবে।
আবার ভারতেও এমন অনেক রাজ্য আছে যারা করোনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত তারা অন্যান্য বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যগুলোকে এইসময় একটু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারে। আবার সমাজের যারা উচ্চবিত্ত আছেন তারা আর্থিকভাবে অনগ্রসরদের এই সময় একটু বেশি করে সহায়তা করলে সুবিধা হয়।
আমি এখন এই লকডাউনের সময় বেশি করে পড়াশোনা করছি। পি এইচ ডির কাজ, রিসার্চ স্কলারদের লেখা সব দেখছি। তাদের লেখা প্রকাশনাও দেখছি। বলা যায়, লকডাউনের এই সময় পড়ালেখা করে বেশ ভালো সময় কাটছে। অতীতে কোচবিহার বাঁকুড়ার পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর গবেষণাধর্মী কাজ করেছি। আবারও এই করোনা দুর্যোগ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর কাজ করবো। সবাই ভালো থাকুন। সবাই মিলে, যে যেভাবে পারেন পরিশ্রম বুদ্ধি দিয়ে চলুন এই দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার শপথ নিই। ”