পরিত্যক্ত জিনিসপত্র দিয়ে হস্ত শিল্পের কাজে পারদর্শী নদীয়ার জয়শ্রী রায় মৈত্র

শিল্পী পালিত ঃ আজ আমাদের এই ওয়েবনিউজ পোর্টাল এর আত্মকথা বিভাগে নদীয়ার কৃষ্ণনগর থেকে লিখেছেন জয়শ্রী রায় মৈত্র —-

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও আমি
———————————-
– জয়শ্রী রায় মৈত্র
———————
কৃষ্ণনগর, নদীয়া
——————–
বীণাপাণি শিল্পী দিদির অনুরোধে আবার খবরের ঘন্টায় লিখতে বসেছি। আমার নিজের কথা । হয়তঃ সব কথা বলা সম্ভব হবে না । তবুও সংক্ষিপ্তাকারে আমার জীবনের প্রতিটি অংশে ছোঁয়া দিয়ে যাবার চেষ্টা করব ।

কিছুদিন আগেই বীণাপাণি দিদির কথায় ‘খবরের ঘণ্টা’-য় আমার নিজের বানানো বিভিন্ন হস্ত-শিল্প সামগ্রী নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান করেছিলাম । সেই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি আমার হস্ত-শিল্প কতটা গুণগ্রাহী হতে পেরেছে । যাঁরা তাঁদের মূল্যবান মতামত ও লাইক দিয়ে আমাকে উৎসাহিত করেছেন তাঁদের প্রতি জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা । আমার মা আমাদের ছেড়ে এই সময়ই চলে গেলেন । আমার স্বামী নার্সিং হোমে ভর্তি হলেন । এই পরিস্থিতিতে আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম এবং বীণাদির কথা সেসময়ে রাখতে পারিনি । রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে লাইভ অনুষ্ঠান করতে পারিনি । এর জন্য আমি ভীষন ভাবে দুঃখিত । আশা করি পরবর্তীতে এরকম অনুষ্ঠান নিয়ে নিশ্চয়ই উপস্থিত থাকব ।

ছোটবেলা থেকেই শিল্প ও সংস্কৃতি মনস্ক আমি। মিশনারি স্কুলে পড়ার জন্য পড়াশোনার প্রচন্ড চাপ থাকত । ফলে সেই সময়ে সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পের প্রতি ঝোঁক থাকলেও ভালো ভাবে দেখার সুযোগ পেতাম না। তবে ছোটবেলা থেকেই ফেলে দেওয়া জিনিসকে কাজে লাগিয়ে কিছু করার প্রচেষ্টা থাকতো । স্কুলের কর্ম-শিক্ষার ক্লাস, ড্রয়িং ক্লাসে খুব উৎসাহ পেতাম। আমার শিল্প-কর্ম ও সৃষ্টির পিছনে আর একটা কারণ আছে । সেটা পরিবেশগত । আমার জন্ম নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে, যে কৃষ্ণনগর মৃৎ-শিল্পের জন্য বিখ্যাত । শিশুকাল থেকে দেখে আসা এই শিল্প-সংস্কৃতি আমাকে অনেকটা উৎসাহিত করেছে । আমার এখনও মনে আছে যখন আমি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যানসিয়েন্ট ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি- তে এম,এ, পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেই সময়েও সুযোগ পেলে পরিত্যক্ত জিনিষপত্র দিয়ে হস্ত-শিল্প তৈরি করেছি ।

এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করার পর কর্মজীবনের মধ্যেই চলতে থাকল আমার শিল্প-কর্ম ও সঙ্গীত আরাধনা । কোল্ড্রিংসের বোতল, আইসক্রিমের কাঠি, ফেলে দেওয়া বিস্কুটের কাগজ, প্রেজেন্টেশন মোড়ানো মার্বেল কাগজ, চায়ের ভাঙা কাপ, পুরনো কাপড়ের টুকরো, ভাঙ্গা পেন্সিল – এরকম সামগ্রী পেলেই সযত্নে রেখে দিতাম এবং সময় বার করে নিজের চিন্তা ধারা দিয়ে শিল্প তৈরি করতাম ।

সঙ্গীত ও শিল্পকলার ব্যাপারে সম্পূর্ণ সহায়তা পেয়েছি আমার মায়ের কাছে। দুর্ভাগ্যবশত যিনি কিছুদিন আগেই ওপারের ডাকে সাড়া দিয়ে হঠাৎই চলে গেছেন চির নিদ্রার দেশে। বাবা নিজে ভালো গান জানলেও পড়াশুনার উপর এত জোর দিতেন গানটা সেখানে নগণ্য হয়ে যেত। মা সব রকম গান শেখার ওপর জোর দিলেও কেন জানিনা রবীন্দ্র সংগীত আমার খুব প্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বিভিন্ন কারণে কয়েকবার গানের চর্চা বন্ধ হয়ে গেলেও এখন নিয়মিত চর্চা চালিয়ে যাবার চেষ্টা করে চলেছি। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতে ‘সংগীত বিভাকর’ ডিপ্লোমাও পেয়েছি। গান আমায় যেমন সুখের দিনে আনন্দ দান করে, দুঃখের দিনেও পরম সাথী হয় । রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য আমার প্রিয় দিদিমণিদের কাছে আমি ভীষন কৃতজ্ঞ । মনে পড়ে যায় তাঁদের কথা । শ্রীমতি পুষ্প বিশ্বাস, শ্রীমতি আলপনা চক্রবর্তী, কুমারী শান্তা মাইতির মত অমায়িক শিক্ষয়িত্রীদের আমি পেয়েছিলাম । বর্তমানে ‘দরবারী’ স্কুলের ছাত্রী আমি। শিক্ষয়িত্রী মৌসুমি সাহা (নুপুর দি) যথেষ্ট উৎসাহ দেন এবং সুন্দর ভাবে গান শেখান । এদের সবার কাছ থেকে আমি বন্ধুত্বমূলক সুন্দর ব্যবহার পেয়েছি এবং যোগাযোগ রেখেছি। আমার বর্তমান শিক্ষয়িত্রী নুপুর দিকে না বলে গানের বাইরে অন্য কোন কাজে আমি হাত দেই না। কর্মক্ষেত্রে সামান্য কিছু কাজের সাথে যুক্ত আমি।

আর লেখালেখি ! কিভাবে যে আমি সাহিত্যের সাথে যুক্ত হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি । কবে যে কবি আখ্যা পেলাম সেটাও প্রথম দিকে টের পাইনি । বর্তমানে পশ্চিমবাংলা ও বাংলাদেশের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা পরিবারের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যাওয়াতে সেটা টের পাই, বুঝতে পারি । যদি কেউ প্রশ্ন করে যে লেখালেখির জগতে আমি কি করে এলাম ! আমার উত্তর হবে হঠাৎই হয়তো রবি ঠাকুরের গানের কলিতে ভেসে চলে এসেছি লেখার জগতে । কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ সব বিষয়েই একটু-আধটু লেখার চেষ্টা করি। আমার লেখার ব্যাপারে অনেকেই আমাকে উৎসাহ জুগিয়েছেন । প্রথমে যার কথা মনে পড়ে সে হল ফ্রেন্ডস এফ,এম রেডিওর একজন বিখ্যাত প্রাক্তন রেডিও জকি RJ Amit । তার গলায় বিভিন্ন নাটক, ছোট গল্প পাঠ শুনতে শুনতে নিজেরও হঠাৎ গল্প লিখতে ইচ্ছা করল। ছোট গল্প ও নাটক পাঠাতে শুরু করলাম ফ্রেন্ডস এফ,এম- এ। বন্ধু অমিতের গলায় নিজের লেখা পাঠ শুনে লেখার জগতে একটু একটু উৎসাহিত হতে শুরু করলাম। তারপরই শুরু হলো বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিন, বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে লেখালিখি। প্রথম আমার একটি কবিতা প্রকাশ পেল ‘বর্ধমান জাগরনী’ পত্রিকায়। কৃতজ্ঞ আমি ওই পত্রিকার সম্পাদক বিকাশ বিশ্বাস মহাশয়ের কাছে। তারপর যুথিকা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ও বিশ্ববঙ্গ সাহিত্যের চেয়ারম্যান সোমনাথ নাগ মহাশয়ের কাছেও বিশেষ কৃতজ্ঞ আমি। যার সহায়তায় নি:খরচায় “রোমান্টিক বিকেল” নামে একটি কাব্যগ্রন্থ ও “সুরের ক্যানভাসে” নামে একটি পরমাণু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়া সপ্তর্ষি প্রকাশনী থেকে ভৌতিক গল্পের বই “অলৌকিক” প্রকাশ পেয়েছে । আমি www.bangla-kobita.com এবং www.tarunyo.com ওয়েবসাইটের নিয়মিত লেখিকা । বাংলা কবিতার আসরের সাইটে আমার লেখা প্রায় ৭৭০টি কবিতা আছে । বর্তমানে বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ও পরিবারের সদস্য হিসাবে আছি । উল্লেখযোগ্য পত্রিকা গুলির মধ্যে রয়েছে যূথিকা সাহিত্য পত্রিকা, মেঘদূত সাহিত্য পত্রিকা, কলম সৈনিক সাহিত্য পরিবার, পারিজাত সাহিত্য পত্রিকা, প্রাঙ্গণ সাহিত্য পত্রিকা, বর্ধমান জাগরণী, ভাষাসরিৎ, শৈশব ইত্যাদি ।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতটাকে যতটা সম্ভব নিজের ক্ষুদ্রতম যোগ্যতায় বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে চলেছি । এই জগতে নিজের অংশগ্রহণ ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকা ও পরিবার থেকে অনেক সান্মানিক ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছি । এর জন্য আমি তৃপ্ত । হস্ত-শিল্পের জন্য India Book of Records-এ জায়গা করে নিতে পেরেছি । Certificate of Appreciation, Medal ইত্যাদি দিয়ে তাঁরা আমাকে সম্মানিত করতে চলেছে । কিন্তূ আমার এই বিভিন্ন পরিসরের কর্মকাণ্ডের পিছনে একজনের সহায়তা ও মানবিক অবদানের কথা না বললে আমি ভূল করব । আজ তার অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা ছাড়া আমার গান, শিল্প সাধনা, লেখালিখি বর্তমানে কিছুই সম্ভব হতো না। তিনি আমার স্বামী দেবদাস মৈত্র । তার কর্মব্যস্ত জীবনে কাজের মাঝেও আমাকে ঐকান্তিক সহযোগিতা করেন । বিভিন্ন ভাবে আমাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন । শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে নিজের অংশগ্রহণ ও অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা এখন যেমন আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে বলে আশা পোষণ করি । তার প্রথম ও প্রধান কারণ আমি একজন শিল্প ও সাহিত্য সত্বার মানুষ ।

আজ নিজের কথা এইখানেই শেষ করছি । আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই বীণাপাণি শিল্পী দিদিকে ও খবরের ঘন্টার সম্পাদক বাপি ঘোষ মহাশয়কে । অনেক অনেক শুভকামনা রইল খবরের ঘন্টার জন্য ।।
ঠিকানা : প্রযত্নে – স্ব: বিমলেন্দু রায়, নগেন্দ্র নগর, থার্ড লেন, ডাকঘর – কৃষ্ণনগর, জেলা – নদীয়া । প: বাংলা ।
ডাকসূচক : ৭৪১১০১
—————————-