বাপি ঘোষ ঃ অতি আধুনিকতা বিশেষ করে অতিরিক্ত নগরায়ন , ভোগবাদ এবং খাদ্য তালিকায় অতি আধুনিকতার জেরেই আজ করোনার মতো রোগ বিশ্ব জুড়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান তথা অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের অধ্যাপক ডঃ ইছামুদ্দিন সরকার । করোনা এবং লক ডাউনের জেরে মানুষের বন্দি দশা নিয়ে তিনি খবরের ঘন্টাকে আরও অনেক কথাই জানিয়েছেন । নিচে তার কথাগুলো মেলে ধরা হল —
“করোনা নিয়ে এটাই বলবো যে আজ মানুষ তার অতি আধুনিকতার ফল ভোগ করছে । আজ বিশ্ব জুড়ে এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বেপরোয়া চালচলন বেড়েছে । কোনও সীমাবদ্ধতার রুপ নেই । আগে মুল্যবোধ ছিল । এখন মুল্যবোধের অবক্ষয় দেখা দিয়েছে । আজকের দিনে বিভিন্ন উৎসব আধুনিকতার লক্ষণ। উৎসবে খাওয়াদাওয়ার পর উচ্ছিষ্ট ফেলে দেওয়ার জন্য কোনও পরিস্কার পরিচ্ছনতা মানা হয় না। লোকে বিরিয়ানি প্যাকেট আনছেন । খেয়েদেয়ে তা ফেলে দিচ্ছেন বাড়ির সামনে রাস্তায় । সেখানে বাড়ছে বিড়াল কুকুরের উৎপাত । তারপর হোম ডেলিভারি বেড়েছে । সেখানে অতিরিক্ত খাবার আসে । খাবার পর মানুষ যেখানে সেখানে অতিরিক্ত খাবার ফেলে দিচ্ছেন । সেখানেও বাড়ছে কুকুর বিড়ালের উৎপাত । এসবের পাশ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে ।
যে দেশ যতো অর্থনৈতিকভাবে উন্নত সেখানে ততোই ভোগবাদ বেড়েছে । কমে গিয়েছে মনুষ্যত্ব বোধ । অতি আধুনিকতার নামে অসভ্যতা বেড়েছে । করোনাতো বলবো আমাদের দেশে পাচার হওয়া রোগ । আগে গরুর গাড়ি চলত। তাতে দুই তিন জন লোক চড়তেন। এখনতো বাস , ট্রেন , বিমান যোগাযোগ । তাতে কতো লোক একসঙ্গে চাপছেন । ফলে করোনার মতো রোগ দ্রুত গতিতে বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারছে। রোগটি ম্যানুয়াল ট্রান্সমিশন বা মানুষ বাহিত । ফলে মানুষের মুভমেন্ট যতো বেড়েছে ততই এই রোগ ছড়িয়ে পড়ছে , তার জন্যই লক ডাউন।
আধুনিকতার বিষময় ফল এই মারন ভাইরাস । আমিতো তাই বলবো । অতি নগরায়নে অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর সব তৈরি হয়েছে । নর্দমাগুলো সব ঠিক নেই । নিকাশিব্যবস্থা সব ভেঙ্গে পড়ছে । জমা জল থেকে মশামাছির উপদ্রব বাড়ছে । হরপ্পা ছিল পৃথিবীর প্রাচীন ও উন্নত সভ্যতা । সেই সভ্যতায়ও বহ কিছু ধ্বংস হয়েছিল । কিন্তু হরপ্পায় নিকাশি ব্যবস্থাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল । তাদের নর্দমাগুলোতে এক অন্যরকম ম্যানহোল থাকতো । যেখানে সেখানে নোংরা ফেলে কেও নর্দমায় জল যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিতো না। কিন্তু আমাদের সভ্যতায় কি তা সেই ভাবে মানা হয়? আপনি শিলিগুড়ি , মাটিগাড়া, শিবমন্দিরের নর্দমা গুলোই দেখুন না । মানুষের ফেলে দেওয়া নোংরা , প্লাস্টিকের আবর্জনায় দেখুনতো কিভাবে নর্দমাগুলো বন্ধ হয়ে আছে । তা দিয়ে জল যেতে না পারায় মশা মাছির উৎপাত থেকে কিন্তু মানুষের বিভিন্ন রোগ বাড়ছে ।
আমেরিকার নগরায়ন , ইতালির ভোগবাদ সেখানকার জীবনযাত্রা আপনি ভাবতে পারবেন না। ফ্রান্সেতো রোমান্টিক লাইফ । সেই সব স্থানে ভোগবাদ আজ চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছে । সেই সব অতি আধুনিক নগর সভ্যতায় ক্যাবারে , নাইট পার্টি , নারী পুরুষের অবাধ মিলন বেড়েছে । প্রাচীন সভ্যতা গ্রীসে এই ক্যাবারে , নারী পুরুষের অবাধ মিলন , সারা রাতের উল্লাস কিন্তু একসময় সেখানে বিরাট বিপত্তি এনেছিল । কিছুদিন আগের এইডস রোগের ভয়াবহ উৎপত্তির কথাতো আমরা সকলে জানি । আপনি শিলিগুড়ির কথাই ধরুন না, সিঙ্গিং বার , ডান্সিং বার কিভাবে বেড়েছে । এইসবের কি কোনও পাশ্বপ্রতিক্রিয়া নেই? মানুষ কিভাবে আরও ভোগ , আরো ভোগ করবে সেই দিকে ঝুঁকে পড়েছে । ভোগ করার নানান সব আধুনিক পদ্ধতি। ও হেনরির একটি লেখা পড়েছিলাম । তিনি ব্যাখা করেছিলেন , ধনীদের দুঃখ কতো । তারা রোজ নিরামিষ খেতে পারবেন না । তাদের নানারকম মাংস চাই । তারপর তারা বাড়িতে খাবারের ডায়েট চার্টও তৈরি করেন । নানারকমের সেই সব খাবারও তাদের কাছে একসময় একঘেয়েমি হয়ে যায় । শেষে অনেকে মানসিক রোগী হয়ে যান ।
আজকে দেখুন চিনের কথা বলছি । মাও সে তুঙের দেশ ওটা । বিপ্লবের দেশ । কিন্তু সেই দেশেও ভোগবাদ প্রবেশ করেছে । তাদের খাদ্য তালিকা দেখুন । ভয়ানক ব্যাপার। বলা হচ্ছে , সেখানের উহানে পেঙ্গুইনের মাংস খেয়ে নাকি প্রথম করোনা ছড়িয়ে পড়ে । আমি বেশ কয়েক বছর আগে চিনে গিয়েছি , তাইওয়ানেও গিয়েছি । বহু কিছু সেখানে কাঁচা খায় , ঠিকমতো রান্না করে না । তাইওয়ানে এক হোটেলে দুই রাত ছিলাম । ওদের খাওয়ার ধরন দেখে প্রায় উপোস ছিলাম আমি । দেখছিলাম , দুই তিন যুবক কোনো একটি পাখি বা প্রানীর মাংস ছোরা দিয়ে ঝিরি ঝিরি করে কাটছে । রান্না করে নি । একটা পাথর বাটির মতো পাত্রে লংকা জাতিয় কিছু চাট ছিল । সেই চাটে মাংস গুলো কাঁচা কাঁচা ডুবিয়ে ওরা মুখে পুড়ছিল । তাই দেখে আমার খাওয়া বন্ধ । কোনোমতে প্রায় অভুক্ত অবস্থায় সেখানে থেকে আমি পালিয়ে আসি বলা চলে । এই যদি খাবারের অসভ্যতা হয় , তবে সেখান থেকে করোনা ছড়াবে নাকি অন্য রোগ ছড়াবে? তাই বলা যায় অতি আধুনিকতা , বৈভব বা অতি ঐশ্বর্য পূর্ণ জীবন , অতি ভোগ , অপরিকল্পিত নগরায়ন , খাদ্য তালিকায় অসভ্য আধুনিকতা এবং অন্যান্য অসভ্যতা যতদিন না যাবে আমাদের মধ্যে ততদিন করোনার মতো ভাইরাস আমাদের পিছু ছাড়বে না। আমাদের এখন অনেক সংশোধন প্রয়োজন ।
এবারে আসি এই লক ডাউনে আমার সময় কাটছে কিভাবে । ছাত্রছাত্রীরাওবা কিভাবে সময় পার করবে সেই বিষয়ে কিছু বলবো । প্রথমেই বলি আমি বই পড়ে সময় পার করছি । লিখছিও খুব । আমার মেয়ের এর আগে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে দার্জিলিঙের শেরপাদের ওপর । সেই বই পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় । এখন মেয়ের আর একটি বই প্রকাশিত হতে চলেছে ইকোলজির ওপর ।সেই বিষয়ে আমাকেও সহযোগিতা করতে হবে । তবে আমি এই সময় লোকসংস্কৃতি নিয়েও কাজ করছি । মালদার লোক সংস্কৃতি গবেষক প্রদ্যুত ঘোষ মজুমদার , কালিয়াগঞ্জের ধনঞ্জয় রায় , পুস্পজিত রায় , শিশির মজুমদার , পবিত্র সরকার তাদের ওপর কিছু লোক সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছি । লোক সংস্কৃতি কিন্তু মানুষে মানুষে মহা মিলনের এক সেতু বন্ধন । গ্রামের উৎসব চড়ক মেলায় দেখবেন জাতিভেদ নেই । চড়ক মেলা একটি লোক উৎসব । গম্ভিরাতে দেখবেন একজনকে শিব সাজানো হয় । শিবকে গ্রামের মানুষ নানা বলেন । যিনি শিব সাজেন তাকে গ্রামের মানুষ প্রশ্ন করেন , তুমি কি সামাজিক দেশের সমস্যা তুলে ধরবে ? যেমন করোনা নিয়ে গম্ভিরা গান পালা হতে পারে ।কিন্তু এবারে করোনার জন্য সেই পালা গান হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে । সেই লোক সংস্কৃতি নিয়ে আমি যেমন এই অবসরে কাজ করছি তেমনি আমার স্ত্রী আয়েশা তেভাগা নিয়ে পরাশোনা করছেন । বালুরঘাটের কাছে পাতিরামের গ্রামে তেভাগা আন্দোলন হয়েছিল । স্ত্রীর বাপের বাড়ি ঐতিহাসিক পাতিরাম গ্রামে । এই রকম পড়াশোনার মাঝে বলবো , ঘরে থেকে অনেক সৃজন করা যায় । বর্ষার সময় ঘর বন্দি থেকে রবি ঠাকুর কিন্তু অনেক কবিতা , গল্প লিখেছেন । আজ এই লক ডাউনে ছেলেমেয়েরা লিখতে পারে , কেন সে খেলাধুলা করবে সেই বিষয়ের ওপর । ঠাকুরমার কাছে শিশুরা পুরানো দিনের গল্প শুনতে পারে । দাদুর কাছে ছেলেমেয়েরা জানতে পারে জীবনের অভিজ্ঞতা । এভাবে জ্ঞানের একটা ট্রান্স মিশন হতে পারে । ঘর বন্দি সময়টা অবহেলায় নষ্ট না করে অনেক ভালো গল্পের বই পড়া যেতে পারে । এই সময় বিদ্যাসাগরের জন্মের দুশ বছর চলছে । তার ওপর পড়াশোনা করা যায় । বিদ্যাসাগরের মহান জীবন , তার জীবনের বিভিন্ন দিক পড়ে ছেলেমেয়েরা বিরাট শক্তি পেতে পারে । সবাই ভালো থাকুন । করোনা ঠেকাতে ঘর বন্দি থাকুন । কেও এই লক ডাউনকে হালকা ভাবে নেবেন না । তাতে কিন্তু বিপদ আরও বাড়তে পারে ।”