পুরাতন মালদার মোহনবাগান গ্রামের তরফদার বাড়ির পুজোয় দেবী দুর্গাকে শাখা নিবেদন করার প্রথা বহু যুগ ধরে চলে আসছে

নিজস্ব প্রতিবেদন ঃ দেবী প্রতিমার কাঠামো তৈরির সময় থেকে শাখা এবং পলা পড়ানো হয়। এলাকাবাসীদের বিশ্বাস দেবী দুর্গাকে শাখা নিবেদন করলেই বাড়ির মহিলারা অবিবাহিত থাকেন না। এমনকি বিবাহিত মহিলাদের সন্তান প্রাপ্তির মনস্কামনা পূরণ হয়। বিয়ের বয়স হলেই বাড়ির মেয়েদের ভালো পাত্রের সঙ্গে বিয়ের জন্য অভিভাবকেরা দেবী দুর্গার কাছে শাখা নিবেদন করে যান। আর বছর ঘুরতেই সেই বাড়ির মহিলার বিয়েও হয়ে যায়। পুরাতন মালদার মোহনবাগান গ্রামের তরফদার বাড়ির দেবী দুর্গার অদ্ভুত এই মাহাত্ম্য যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। প্রায় ১৭০ বছরের পুরনো পুরাতন মালদার তরফদার বাড়ির দুর্গাপুজো। দেবী দুর্গা এতটাই জাগ্রত যে তরফদার বাড়িতে কোনদিনই মাছ, মাংস সহ আমিষ খাবার ওঠে না। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু হওয়া পুরাতন মালদার তরফদার বাড়ির দুর্গাপুজো গ্রামবাসীদের কাছে জাগ্রত মায়ের আরাধনা হিসেবে প্রচলিত রয়েছে।
পুরাতন মালদা থানার মুচিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের মোহনবাগান এলাকায় রয়েছে তরফদার পরিবারের দেবী দুর্গা মন্দির। আর ওই মন্দিরের সংলগ্ন জায়গাতেই একান্নবর্তী পরিবার তরফদার বাড়ির । বর্তমানে ওই পরিবারের চার শরিক রবীন্দ্রনাথ তরফদার, বিষ্ণুপদ তরফদার, গোবিন্দ তরফদার এবং মানিক তরফদার। বাড়ির পূর্ব পুরুষের হাত দিয়ে তৈরি হওয়া এই দুর্গা পুজোর আয়োজন করে আসছেন। প্রত্যেকে শরিকেরা বিবাহিত। তাদের সংসার রয়েছে এবং প্রত্যেকেই দেবী দুর্গার আশীর্বাদে নিজেদের ব্যবসা কাজে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু পরিবারটি একান্নবর্তী আজও এক হাঁড়িতেই রান্না করে পুজোর চার দিন আনন্দ উৎসব করে থাকেন। তরফদার পরিবারে রাধাগোবিন্দ থাকার কারণে সেখানে আমিষের কোন প্রচলন নেই।
তরফদার পরিবারের এক প্রবীণ সদস্য রবীন্দ্রনাথ তরফদার বলেন , ১৮৫০ সালে বাংলাদেশে পূর্বপুরুষ চন্দনাথ তরফদারের উদ্যোগেই শুরু হয়েছিল দুর্গাপুজো। সেই সময় পূর্বপুরুষ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। দেবী দুর্গার স্বপ্ন দেখেই সেই শুরু পুজোর। এরপর ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ থেকে সেই পুজো পূর্ব পুরুষের হাত ধরে চলে আসে এদেশের পুরাতন মালদার মোহনবাগান এলাকায়। আজও সেখানেই পুরনো নিয়ম মেনেই পুজো হয়ে আসছে।
তরফদার পরিবারের বিশ্বাস দেবী দুর্গা তৈরির শুরু থেকেই মায়ের হাতে শাখা-পলা পড়িয়ে মূর্তি গড়া হয় । কারণ, দেবি মাতা এতটাই জাগ্রত যে এই এলাকায় কোনদিন কোন মেয়ের বিয়ে থেমে থাকে নি । ভক্তিভরে যেসব পরিবারের অভিভাবকেরা মেয়ের বিয়ের জন্য দেবী দুর্গাকে শাঁখা দিয়ে গিয়েছেন। বছর ঘুরতেই সেই বাড়িতে বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। এবং দেবী দুর্গার আশীর্বাদে এলাকার কোন পরিবারে অশান্তি নেই। যে যতটকুই রুজি-রোজগার করুক না কেন, প্রত্যেকের সংসারে শান্তি বিরাজ করছে। তাই এখনো গ্রামবাসীদের বিশ্বাস দেবি মাতা খুবই জাগ্রত। পুজোর চার দিন পাড়া-প্রতিবেশীদের অনেকেই নিরামিষ খেয়ে দেবী দুর্গা পুজোয় সামিল হন।
ওই পরিবারের প্রবীণ কর্তা রবীন্দ্রনাথ তরফদার জানিয়েছেন, প্রায় ৩৬ বছর ধরে বংশপরম্পরায় মৃৎশিল্পী প্রভাত চন্দ্র পাল প্রতিমা করছেন। যতদিন তিনি প্রতিমা করেন তিনিও নিরামিষ খান। মূলত আমাদের বাড়ির দেবী মায়ের কাছে অনেকেই মেয়েদের বিয়ে না হওয়া এবং সন্তানের জন্য মানত করে। দেবী দুর্গাকে শাখা পলা দিলেই তার ফল প্রাপ্তি হবেই এই বিশ্বাস যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। তাই আজও পুজোর কটা দিন তরফদার বাড়ির দেবী দুর্গা পুজোয় বহু মহিলারা আসেন, তাদের বাড়ির মেয়েদের ভালো জায়গায় বিয়ে দেওয়ার জন্য মানত করতে। আবার অনেকে আছেন সন্তানের প্রাপ্তি লাভের মানদ করতে। শাখা দিয়ে ভক্তিভরে মানত করলে বছর ঘুরতেই সেই মনস্কামনা পূরণ করে স্বয়ং দেবী দুর্গা , এমনই বিশ্বাস এখনো আমাদের মধ্যে রয়েছে।