শিল্পী পালিতঃ আজকের আত্মকথায় মেলে ধরা হলো গড়িয়ার বাঁশদ্রোনী থানার পূবালি ঘোষ চট্টোপাধ্যায়ের কথা–
“সবাইকে জানানোর মত ব্যক্তিজীবন আমার নয়। খুব সামান্য মানুষ আমি। তবু তাতে আমার কোনো হীনমন্যতা নেই।যা পাইনি তা নিয়ে হাহাকার করার ইচ্ছে আমার হয়না, যা পেয়েছি, তাতেই আমার দু’হাত উপচে পড়েছে। আমি আমার জীবন নিয়ে খুশি।দুঃখ তো জীবনের অঙ্গ। তাতো থাকবেই। জীবন জুড়েই দুঃখ আছে।তবু তাকেও আমি বরণ করে নিয়েছি ভালোবেসেই।
মুর্শিদাবাদের মফস্বল শহর বহরমপুরের সরকারি হাসপাতালে আমার জন্ম! আমি মায়ের দ্বিতীয় সন্তান এবং দ্বিতীয় কন্যা। আমার বাবা ছিলেন ওই শহরের নামকরা কলেজ, কৃষ্ণনাথ কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। কিন্তু দ্বিতীয় সন্তান কন্যা বলে তিনি কোনো দুঃখ পাননি।সস্নেহে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সেই স্নেহময় বক্ষ বহুদিন আগে হারিয়ে ফেলেছি। আর কোথাও এমন স্নেহময় পুরুষ খুঁজে পাইনি।
ছোটো বেলায় আমি এমনিতে খুব শান্ত আর ভীতু টাইপের ছিলাম। কিন্তু দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় চাপলে আর রক্ষে নেই।ভাইবোন,দিদিকে অসম্ভব ভালোবাসতাম।এখনও বাসি।আর যাদের ভালোবাসি,তাদের সব অপকর্মের দায় নিতাম অনায়াসে। একবার ছোটো বোনের এমনই কোনো দুষ্টুমির দায় মাথায় নিয়ে মায়ের কাছে বকুনি এবং মারও খেয়েছিলাম। মা কক্ষণো আমার গায়ে হাত তোলেননি,তাই বড় অভিমান হয়েছিল। অমনি মনের দুষ্টবুদ্ধির প্ররোচনায় একটা অপকর্ম করে বসলাম। মায়ের সমস্তরকম চাবির গোছা আলমারির মাথার একটা কোণে থাকতো। সেটা নিয়ে দিলাম ফেলে জালার জলের মধ্যে। হ্যাঁ,বাথরুমে জল ব্যবহারের জন্যে একটা বড় মাটির জালায় জল ভরে রাখা থাকতো,তাতেই। শেষে মায়ের প্রবল খোঁজাখুঁজিতে বিব্রত হয়ে সেটা স্বীকার করে ফেলি। সত্যিকথা বলার জন্যে মায়ের বকুনি খেতে হয়নি।
অর্থের অভাব কখনও মনে দারিদ্র্য আনতে পারেনি।বাবা আমাদের আরকিছু দিতে না পারলেও মনের রত্নভান্ডারের চাবিকাঠিটা দিয়েছিলেন, সেটা হল গল্পের বইয়ের অগাধ ভাণ্ডার। আমরা পড়তে পড়তে কোথায় যেন হারিয়ে যেতাম। ভালোবাসতে শুরু করলাম রবীন্দ্রনাথ,অবনীন্দ্রনাথ,উপেন্দ্রকিশোর,সুকুমার,সত্যজিত,লীলা মজুমদার,একে একে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল আর অনুবাদে বালজাক,আনাফ্যাঙ্ক,শেক্সপিয়ার, ম্যাক্সিমগোর্কি,পার্লবাক…আরও কত! এই চাবিটা আমি আমার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিতে পেরেছি, এটুকুই আমার সান্ত্বনা!
মনেপড়ে..আমি তখন বছর চারেকের,দিদি সাড়েসাত।বাবা সকালেই বলেছে রেডিও আনবে! তা সেতো কলেজ করে তারপর। আমি আর দিদি হাঁ করে জানলায় দাঁড়িয়ে! অবশেষে বিকেল পাঁচটায় বাবা এল।সঙ্গে বেশ বড় একটা রেডিওর বাক্স।আলমারির মাথায় ঠাঁই হল তার।ব্যাটারিতেও চলে।প্রথম গান শুনেছিলাম দেবব্রত বিশ্বাস এর কণ্ঠে… ‘আজ বারি ঝরে ঝরো ঝরো ভরা ভাদরে’…
গান এত সুন্দর হয়! আমার কান ভালো না, স্বরলিপি কাকে বলে জানতাম না,বালিকার অবাক বিস্ময়ে সুরে বসানো কথা শুনতাম। মুখস্থ হয়ে যেত। পরে আবার সেই গান একই সুরে অন্য কণ্ঠে শুনে ভাবতাম এঁরা সুর মনে রাখেন কি ভাবে?
ভোর বেলা রেডিওর সিগনাল শোনার পর আর কোনোদিন শুয়ে থাকিনি।উঠে পড়তাম।ছ’টা কুড়ি। রবিঠাকুরের গান হবে যে…তারপর সাতটা চল্লিশ, তারপর ন’টা কুড়ি। সব শুনতাম।বোন বেশ ভালো গাইতো,সুরে গাইতো,মাও। আমার গলায় সুর ছিলো না কিন্তু প্রাণে ছিলো,আজও আছে !
দিদি রোজ ভোরে সাদা জামা,মেরুন স্কার্ট, লাল মোজা,কালো জুতো পরে স্কুলে যেতো।লোভীর মত তাকিয়ে থাকতাম।আমি ভর্তি হবো ছ’বছর হলে।ততদিনে আমার অক্ষর পরিচয় আর বই পড়তে শেখা শেষ।
এরপর স্কুল জীবন। স্কুলটা কি বড়! মাঠে দু’শ মিটার দৌড় অনায়াসেই অনুষ্ঠিত হতো। কত আমগাছ,জামরুল গাছ।একটা আমড়া গাছও ছিলো। আমি প্রথম দিন স্কুলে গিয়ে একটা ক্লাস শেষ হতেই ব্যাগপত্তর নিয়ে মাঠে চললাম। ঘুরে দেখতে হবে তো! ইতিমধ্যে পরের ক্লাস শুরু হয়েগেছে, আমাকে খুঁজে না পেয়ে দিদির ক্লাসে নালিশ গেল। দিদি কেঁদে ফেলল,বোনটা হারিয়ে গেছে ভেবে। ততক্ষণে প্রকৃতি দর্শন করে আমি আবার ক্লাসে ফিরেছি। টিচার এই বোকা মেয়েটাকে না বকে আদর করে বুঝিয়ে দিলেন স্কুল শুরু হবার পর ক্লাসেই বসতে হয়।
আমরা থাকতাম ভাগীরথী নদীর তীরে একটা দোতলা ভাড়া বাড়িতে। বিকেলবেলা জানলায় বসে বসে নদীর পারে দিগন্তে সূর্যের অস্ত যাওয়া দেখতাম মুগ্ধ হয়ে আর বেসুরে গাইতাম,” সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢলি”…।
সন্ধ্যে সাতটার মধ্যে স্কুলের পড়া শেষ। নিজেই পড়তাম। তারপর রেডিও শুনতাম মন দিয়ে।আমার প্রিয় বই ছিল সঞ্চয়িতা। হাতে নিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতাম। যেদিন দেখলাম ” “তার অন্ত নাইগো যে আনন্দে গড়া আমার অঙ্গ”… গানটা হচ্ছে, আর সেটা ওই বইয়ের পাতায় লেখা! আমার সে কি রোমাঞ্চ!
কত লিখবো? জীবনের সবকথা কি লেখা যায়? অনেক অনেক পড়াশোনা করে কলেজে পড়াবো বাবার মতো এই একটাই স্বপ্ন ছিল,সফল হলোনা।বড় হলাম, ইউনিভার্সিটি শেষে চাকরিও পেলাম,ততদিনে আমার জীবনের বড় আশ্রয় বাবা চলে গেছেন। ভাইবোন ছোট।বড় দুইবোনের ওপর সংসারের ভার! তাই যে চাকরি পেলাম, তাই নিতে হলো। আমার মা ছিলেন সেযুগের সাম্মানিক স্নাতক। সংসারের প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। অসম্ভব শিল্পবোধে পরিপূর্ণ, কিছুটা উদাসীন একটা মানুষ। কত গল্প শুনেছি,যেগুলো কোনো বইয়ে পাওয়া যাবেনা। কি সুন্দর গানের গলা,আঁকার হাত! কোনো গুরুত্ব পেলনা মানুষটার এসব গুণগুলো। বড় কষ্ট হয় মায়ের কথা ভাবলে। ২০০৫ এর মার্চে চলে গেল মা! আমার মনে হলো, অর্ধেক আকাশ বুঝি নেই। সত্যিই নেই। আমার আশ্রয় হারিয়ে গেল।
নিজে বিয়ে করেছিলাম, সব তো খাঁজেখাঁজে মেলেনা, আমাদেরও মেলেনি। আমারই কি সব ওর চোখে ভালো! এমন হয়না। হতে পারেনা। ও নিয়ে ভাবিও না।যেটুকু মিলেছে, তাতেই আমি সুখী। আসলে সুখী কেউ কাউকে করতে পারেনা! সুখী হতে পারতে হয়। আমি পারি। মেয়ে চেয়েছিলাম, ছেলে এল কোলজুড়ে। তাতেই আমি খুশি।
জীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি।মুখবই এখন আমার খোলা জানালা।কত মানুষ আমাকে ভালোবাসে, আমিও বাসি।মনোমালিন্য হয়,কষ্ট পাই। আবার ভুলেও যাই।
হৃদযন্ত্র এখন বিকল, পরিশ্রম সয়না মোটে।জানিনা কবে ডাক এসে যাবে!
আমার আবার ফিরতে বড় সাধ।
” আবার যদি ইচ্ছা করো
আবার আসি ফিরে…।
মনে মনে আবৃত্তি করি,
” মনেরে আজ কহ যে
ভালোমন্দ যাহাই ঘটুক
সত্যেরে লও সহজে।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বাসতে পারে না যে
কেউ বিকিয়ে আছে,
কেউ বা সিকি পয়সা ধারে না যে!
কতকটা সে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারও ভাই,
কতকটা এ ভবের গতিক
সবার তরে নহে সবাই! ”
আরও কত কথা আছে। সব লিখতে নেই।
© পূবালী ঘোষ চট্টোপাধ্যায়
ঠিকানা :শুভদা অ্যাপার্টমেন্ট,ফ্ল্যাট নং কে-5, পি-125 ঊষাপার্ক
থানা: বাঁশদ্রোনী
পোস্ট অফিস: গড়িয়া
পিনকোড: 700084