বাপী ঘোষ ,শিলিগুড়ি সেই মহান কবি তখন বাক রুদ্ধ। কারও সঙ্গে কথা বলেন না। তিনি
কথা না বলুন কিন্তু তার মতো ভারত জুড়ে খ্যাতি অর্জন করা কবিকে একবারতো চোখের
দেখা যেতে পারে। সেই ভাবেই ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কলকাতা
শ্যামবাজারের ভুপেন বসু এভেনিউয়ে যাওয়া। মহারাজা মনিন্দ্রচন্দ্র কলেজের কাছে
বিদ্রোহি কবি তখন ভাড়া থাকেন। কবি যেহেতু অসুস্থ তাই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য
তার শাশুড়ি গিরিবালাদেবি মাত্র পাঁচ মিনিট সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। নির্ধারিত সময়ের
মধ্যে সেই মহান কবির সঙ্গে দেখা করে তাকে দেবতা ভেবে দুই হাত জোড় করে প্রনাম
জানিয়ে চলে আসেন তারা। কিন্তু আজও এই পচাশি বছর বয়সেও সেই মহান কবির সঙ্গে
মাত্র পাঁচ মিনিটের দেখা করার স্মৃতি পিছু টান দিয়ে চলেছে উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট
সাহিত্যিক তথা গবেষক ডঃ গৌরমোহন রায়কে।
শিলিগুড়ি সুকান্ত নগরে থাকেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ডঃ গৌরমোহন রায়। প্রকৃতপক্ষে তার
জন্ম উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত সন্নিহিত বামনগাছি গ্রামে। কাজিপাড়া উচ্চ ইংরেজি
বিদ্যালয় থেকে স্কুল জীবন শেষ করে কলকাতার সিটি কলেজ এবং মহারাজা মনিন্দ্র
চন্দ্র কলেজ থেকে তিনি কলেজ জীবন শেষ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ
পাশ করার পর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পি এইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্ম জীবনে উত্তর ২৪ পরগনার জুনিয়র হাই স্কুল এবং হুগলী জেলার তারকেশ্বর হাই
স্কুলে শিক্ষকতার পর দার্জিলিং লরেট কলেজে অধ্যাপনা করেন।
সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় নিয়ে বিশেষ গবেষণা করে তার ওপর বেশ কয়েকটি
বই লেখেন। এ পর্যন্ত গৌরমোহনবাবুর ১৪ টি বই প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে। বের
হয়েছে একটি কাব্য গ্রন্থ বিষণ্ণ বাতাসে একাকি। আর তার সেই কাব্য গ্রন্থের ৯০টি
কবিতায় বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলামের ভাব প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি নিজেই
বলেন, নজরুল ইসলাম ছিলেন মানবতার সেবক ও ধারক। জাতিধর্ম নির্বিশেষে তিনি ছিলেন
সর্বসাধারণের কবি। তাকে আমি মহামানব বলে মনে করি। তিনি আমার কাছে জীবন
প্রেরনা। তাই আমার কবিতাগুলোয় আমার নিজস্ব ধরন থাকলেও সবেতেই ভাব কিন্তু
নজরুলেরই প্রতিফলিত হয়েছে।
নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্থানের ১৮ টি সংস্থা থেকে
সম্মানিত হয়েছেন গৌরমোহনবাবু। এতসব ভালোবাসার পরও আজও জীবনের শেষ সময়ে
পৌঁছেও কিন্তু মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিদ্রোহী কবির সঙ্গে পাঁচ মিনিটের সেই সাক্ষাৎ
ভুলতে পারেন নি। জীবনের প্রতি মুহূর্তে তার মনের ভিতরে নজরুলেরই ভাব খেলা করে
চলেছে। তার মনের ভিতরে এই বৃদ্ধ বয়সেও বেজে চলেছে, –মহাবিদ্রোহি রন ক্লান্ত, আমি
সেই দিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশেবাতাসে ধ্বনিবে না।
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রনভুমে রনিবে না, বিদ্রোহী রনক্লান্ত, আমি সেইদিন হব
শান্ত –।
গৌরমোহনবাবু বলেন, তখন আমি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসের
প্রথম সপ্তাহ। তখন সকাল দশটা।প্রকৃত তারিখ মনে নেই। আমি আমার পিসিমার ছেলে
উমাচরনকে সঙ্গে নিয়ে বাগবাজার থেকে গিয়েছিলাম বিদ্রোহী কবির ভাড়া বাড়ি
শ্যামবাজারের ভুপেন বসু এভেনিউতে। মহান কবি ছিলেন দুই তলায়। আমরা নিচ তলায়
দরজাতে টোকা দিতেই বেরিয়ে এলেন, এক বয়স্কা মহিলা। সাদা কাপড়ের কিছু কিছু স্থানে
হলুদের দাগ। পরে জেনেছিলাম, তিনি বিদ্রোহি কবির শাশুড়ি। নাম গিরিবালা সেনগুপ্ত। তার
কাছে আমরা কবির সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি জানালেন, তিনিতো
অসুস্থ, কারো সঙ্গে কথা বলেন না। আমরা বললাম, কথা না বলুন, আমরা তাকে একবার
চোখের দেখা দেখবো। কবির তখন ভারত জোড়া খ্যাতি। শেষ কথা বলেছিলেন ১৯৪৩ সালে।
৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেন্ট জেভিয়াসের একদল ছাত্রের সঙ্গে দেখা করে তিনি শেষ
নাকি কথা বলেছিলেন। এরপর থেকেই তিনি অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েন। তবু এই রকম মহান
কবির সঙ্গে একবার দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করলে তার শাশুড়ি মা জানালেন, পাঁচ
মিনিটের বেশি কবির সামনে থাকা যাবে না। আমরা তাতেই রাজি।তার শাশুড়ি মায়ের পায়ের
ধুলো নিয়ে একটি কাঠের সিঁড়ি দিয়ে আমরা উঠলাম দুই তলায়। খোলা একটি বারান্দা, তাতে
ছাদ নেই। ছোট একটি ঘর, পুরানো বাড়ি। মাঝখানে দরজা, দুই পাশে জানালা। সেখানে গিয়েই
দেখি, কবি বসে আছেন মেঝের মধ্যে মাদুর পেতে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। ডাগর চোখ। তার
সামনে দুই তিনটি খাতা, একটি রাইটিং প্যাড। দুই তিনটি কলম। বাড়ির লোকের আশা, যদি
তিনি কিছু লেখেন। তাই তার সামনে কাগজ কলম। কিন্তু তার সামনে যাওয়া মানা। যেমন ভাবে
দূর থেকে দেবতাকে প্রনাম করা হয় তেমনিভাবে আমরা তাকে দূর থেকে প্রনাম করলাম।
উনি আমাদের দিকে ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকলেন। এভাবে তিন চার মিনিট অবাক
বিস্ময়ে তার দিকে খালি তাকিয়ে থাকলাম। আমরাও যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। এভাবে
মিনিট চারেক থাকার পর আমরা বিস্ময়ে দেখলাম এই মহান কবির পাশের জানালার ধারে
এক জন মহিলা পঙ্গু অবস্থায় চৌকিতে শুয়ে আছেন। পরে জানলাম, ইনি ছিলেন তার
দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমীলা সেনগুপ্ত। আমরা তার শাশুড়ি মায়ের কথা মতো পাঁচ মিনিটেই ওপর
থেকে নিচে নামাতে তার শাশুড়ি মা খুশি হয়ে আমাদের আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, তোমাদের
মঙ্গল হোক। সেই স্মৃতি আজও ভোলার নয়।
পরে বিভিন্ন কবিতা লেখায় নজরুলের ভাব অন্যভাবে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন গৌরমোহনবাবু।
তার লেখা মনিষী ম্যাক্সমুলার ইত্যাদি প্রবন্ধে নজরুলের বিবাহ নিয়ে একটি প্রবন্ধ
লিখেছেন। তাছাড়া একটি স্থানে এই দেখা করার বিষয়টি নিয়ে তিনি লিখেছেন। আগামীদিনে
আরও কিছু লিখতে চান। তার কথায়, নজরুল ইসলাম ছিলেন সাম্যের কবি। তিনি ছিলেন
সাধারন মানুষের কবি। ভারতের আপামর সাধারন মানুষের কাছে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন তার
লেখনির মাধ্যমে। তিনি মুসলিম হলেও অনেক শ্যামা সঙ্গীত লিখেছেন। তিনি রোজ কালি
মায়ের পুজো করেছেন। রোজ তিনি কালি মার কাছে জবা ফুল নিবেদন করতেন। নজরুল ছিলেন
গরিব মানুষের বন্ধু। তিনি নিজে চরম দারিদ্রতার মধ্যে লড়াই করেছেন। আবার তিনি তার
নিজের মুসলিম ধর্মের প্রতি পরম শ্রদ্ধায় অনেক লেখালেখি করেছেন। তার সঙ্গীত আজও
আমাদের ভাব জগতকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়। আজ তার মতো