শিল্পী পালিত ঃ বিশ্বজুড়ে এখন করোনা দুর্যোগ। আমাদের দেশে করোনার হাত থেকে বাঁচতে শুরু হয়েছে লকডাউন। বহু মানুষ ঘরবন্দি। এই অবস্থায় ঘরবন্দি মানুষকে সৃজন কাজ যেমন লেখালেখি, সঙ্গীত চর্চা, কবিতা, ছড়া, অঙ্কন প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করার আবেদন জানিয়েছেন খবরের ঘন্টার সম্পাদক বাপি ঘোষ। খবরের ঘন্টার আবেদনে সাড়া দিয়েছেন বহু মানুষ। শিশুরাও সুন্দর সুন্দর সব করোনা বিরোধী ছবি একে মানুষকে সচেতন করতে চাইছে। খবরের ঘন্টার ফেসবুক পেজ ও গ্রুপে সেসব পোস্ট হয়েছে। আজ এই ওয়েবপোর্টাল নিউজে পোস্ট করা হলো শিলিগুড়ি মিলনপল্লীর বৈশাখী বোসরায়ের একটি করোনা সম্পর্কিত গল্প।গল্পের নাম পাঞ্চজন্য।
পাঞ্চজন্য —
বাবান,তুই এখনও ঘুম থেকে উঠলি না!
__উঃ,একটু ঘুমোতে দাও না,মা!
— এগারোটা বাজে,আর কত ঘুমোবি?
__এইজন্যই বাড়ি থাকতে চাই না।একটু ঘুমোতেও দাও না তোমরা শান্তিতে।
__ছেড়ে দাও নীলিমা, ওকে ঘুমোতে দাও,ওর যখন ইচ্ছে উঠবে।সারারাত মোবাইলে গেম খেলেছে।
—বেশ,বেশ, সারারাত জাগবে,আর দিনে ঘুমোবে! আমার হয়েছে যত জ্বালা! এমনিতেই চারদিকের এই অবস্থায় চিন্তায় মরে যাচ্ছি, তার ওপর এই ছেলে জ্বালিয়ে মারলো!একটু যে হাতে হাতে কাজ করবে তাও নয়।__গজগজ করতে করতে বাসি বাসন মাজা শুরু করলো নীলিমা। দেবাশীষ ওয়াশিং মেশিনে কাপড় সাবান দিয়ে চালিয়ে দিয়ে এলো।আজ পনেরদিন ধরে সবাই গৃহবন্দি।কি একটা রোগ এসেছে কোভিড১৯ ! ভীষণ ছোঁয়াচে রোগ।তাই যে মেয়েটি নীলিমাকে কাজে সাহায্য করে ওকেও আসতে না করে দেওয়া হয়েছে। চাকরি-বাকরি সামলে, বাড়ির সবকাজ করার অভ্যেস অনেকদিন ছুটে গেছে নীলিমার। এখন দেশের এই ভয়াবহ অবস্থায় একরকম বাধ্য হয়েই আরতিকে সবেতন ছুটি দিতে হয়েছে। মানুষের ছোঁয়াতেই তো রোগটা ছড়ায়! তাই বাঁচার একমাত্র উপায় হলো গৃহবন্দি থাকা। অগত্যা—
__শোনো নীলিমা, এতো রাগ করোনা ওর ওপর।বেচারা কী করবে বলো তো?আজ দশদিন ও ঘরে বন্দি।সেই ভোরবেলা থেকে রাত পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করা ছেলেটাকে ঘরে ঢুকে থাকতে হচ্ছে। বন্ধুবান্ধব কারো সাথে দেখা পর্যন্ত করতে পারছে না!সবাইতো এখন এখানেই আছে, তবুও! ভালো লাগে বলো ওর? আমাদেরই পাগল পাগল দশা,আর ওতো বাচ্চা ছেলে! তাই, যা নিয়ে থাকে থাক, তবুও তো ঘরে আছে। প্রথম দু-তিন দিন বাবানকে ঘরে আটকাতে নীলিমা হিমসিম খেয়ে গেছে। একবছর পর বাবানের সব বন্ধুরা একসাথে শহরে ফিরেছে,এই ভয়ঙ্কর সংকটে।দেখা করার জন্য সবাই পাগল। চিৎকার চেঁচামেচিতেও যখন ওকে আটকানো যাচ্ছে না, ঠাণ্ডা গলায় নীলিমা ওকে বলেছিল,–তুই তো মহারাষ্ট্র থেকে এসেছিস, ওখানে রোগটা খুব ছড়িয়েছে, ঠাকুর না করুন,তোর যদি কিছু হয়ে থাকে, তাহলে তো আরও অনেকেরই হবে তোর থেকে। তাহলে ওই আমলার ছেলে আর তোর মধ্যে কী পার্থক্য থাকলো,বলতো?বাবান আর কথা বাড়ায়নি, বেরোয়নি,গুম হয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেছে।
দিন পনেরো আগে হঠাৎ ভোরবেলা বাবানের ফোন, অসময়ে,খুব উত্তেজিত___মা, করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা পৃথিবী তোলপাড়, মহারাষ্ট্রে এতো লোক পজিটিভ, সব স্কুল কলেজ ছুটি দিয়ে দিচ্ছে! আমাদের এখান থেকে তিরিশ মিনিট দূরের,পিম্পিরিতে ছয়টা পজিটিভ কেস পাওয়া গেছে,১৪৪ধারা লাগু হয়েছে ওখানে। তবুও আমাদের কলেজ বলছে ছুটি দেবে না।তাই আমরা মুখ্যমন্ত্রী থেকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর পর্যন্ত ফোন করেছি,টুইট করেছি। আমাদের ফোন পেয়ে কাল রাতে কলেজে পুলিশ এসেছিল।আজ গভর্নিং বডির মিটিং হবে, হয়তো কালই হোস্টেল খালি করে দিতে বলবে। তুমি আজই টাকা পাঠাও। কলেজ ছুটি দিলেই টিকিট কাটবো, নয়তো এরপর ফ্লাইটও বন্ধ হয়ে যাবে।লকডাউন শুরু হবে দু-এক দিনের মধ্যেই।—কত টাকা পাঠাতে হবে রে, চিন্তিত ভাবে বলল নীলিমা। পনেরো হাজার মতো পাঠাও। ফ্লাইটের ভাড়াও অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে ,মা! পুনে থেকে শিলিগুড়ি ,সতেরো- আঠারো হাজার টাকা!আমি দেখছি বম্বে থেকে কমদামে কোনও ফ্লাইট পাই নাকি! হয়তো মাঝরাতে আসতে হবে।—সাবধানে আসিস। খুব চিন্তায় থাকলাম।
বাবান পুনে থেকে একটু দূরে,তালেগাঁও-এ একটা কলেজে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে।বছরে দু-বার মাত্র বাড়ি আসার সুযোগ পায়।আসলে ওদের পড়াটা আর পাঁচটা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো নয়।জাহাজে থাকতে হবে দিনের পর দিন, তাই ওদের শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ট্রেনিং চলে, অনেকটা সেনাবাহিনীর ধাঁচে।সেই ভোরবেলা উঠে পিটি,দৌড়ঝাঁপ ইত্যাদি,ঘড়ি ধরে সব কাজ।নিজের ঘর গুছিয়ে রাখা থেকে নিয়ে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা,নিয়মানুবর্তিতা ,জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত যাবতীয় দিকে নজর রাখা হয়।একটু এদিক ওদিক হলেই শাস্তিও বেশ কড়া।তাই বাচ্চাগুলো সবসময় সন্ত্রস্ত হয়েই থাকে।বাবান ওর মাকে মাঝে মাঝেই বলে—জানো না তো,বাঘের খাঁচায় আছি।একদিন এখানে থাকলেই বুঝতে পারতে কি মজা!—বাবান,আমি কিন্তু তোকে ওখানে পাঠাইনি,তুই নিজেই গেছিস।তোরই না পৃথিবী ঘোরার শখ!—হ্যাঁ মা,সেই জন্যই তো এত কষ্ট করছি,বাবানের চোখে স্বপ্ন।—কিন্তু এখন সেই সারা পৃথিবীর লোকই তো নিজের নিজের দেশে ফেরার জন্য পাগল হচ্ছে রে,বাবান!
টিভির আওয়াজে ঘোর কাটলো নীলিমার।ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা ষোলশো ছাড়িয়েছে।মৃত তিরিশের বেশি।তবে বেশ কিছু মানুষ সুস্থ হয়ে উঠছেন,এটাই যা আশার কথা।তৃতীয় স্থরের দোরগোড়ায় ভারত।টিভির ঘোষিকা প্রাণপণে ঘোষণা করে চলেছেন,—এই মহামারী থেকে বাঁচতে চাইলে আপনারা ঘরে থাকুন, ঘরে থাকুন।আর ঘরে!পাগলও তো নিজের ভালো বোঝে, সুস্থ মানুষ কেন বোঝে না!নইলে ঘরে ঢোকানোর জন্য পুলিশকে লাঠিপেটা করতে হয়!
—বাবলু ফোন করেছিল আজ? ছেলেটা তো কথাই বলতে চায় না!—তুমি বুঝতে পারছো না, ও ভীষণ চাপে আছে।চারিদিকে মহামারীর আতঙ্ক, তবুও তার মধ্যেই ওদের কাজ করতে হচ্ছে।ওরা যে স্বাস্থ্যকর্মী! ওদের দিকেই তো সবাই তাকিয়ে আছে।—কি জানি গো,কি যে হবে!ভাবলেই আমার বুক কেঁপে ওঠে।সেদিন ও যখন কয়েক ঘন্টার জন্য এসেছিল, ফেরার সময় ওকে একটু ছুঁয়েছিলাম।ও চমকে উঠে বলল,—আমাকে ছুচ্ছো কেন? যাও,এখুনি হাত ধোও।বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল।আমি তো মা!নীলিমা ছলছল চোখে রান্না করতে গেল।—মা,আমাকে দুটো ডিমভাজা করে দাও।—না বাবান,একটাই খা।জানিনা আর কতদিন আমাদের এইভাবে গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হবে!ঘরে যা আছে তাই দিয়েই কোনরকমে চলতে হবে।বাজারে যাওয়াও যে এখন বিপদজনক!—সামান্য দুটো ডিম চাইলাম,সেটাও দেবে না ,মা!—বাবান,আমরা তো তবু তিনবেলা-চারবেলা যা হোক খাচ্ছি, দেশের দিন আনে দিন খায় ,এমন কত মানুষ যে না খেয়েই রাতে ঘুমোতে যাচ্ছে! দুপুরে খাওয়ার পর সিঙ্কের বাসনগুলো মাজতে গেল নীলিমা।—মা,তুমি সরো,আমি বাসন মেজে দিচ্ছি।অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকালো নীলিমা
সকাল থেকেই কতগুলো পাখি কিচিরমিচির করেই চলেছে। বাড়ির সামনের সেগুনগাছ দুটো কাটার পর থেকে পাখির ডাক আর শোনা যেত না।নীলিমার শোয়ার ঘর থেকে একটা আমগাছ দেখা যায়।আমের বোলের গন্ধ ভেসে আসছে।একটা কোকিল কখন থেকে ডেকেই চলেছে।কত বছর পর!কত নাম না জানা পাখির ডাকও যে শোনা যায় এখন!মানুষগুলো ঘরে থাকায় দূষণ কমেছে, প্রকৃতিও যেন একটু নিশ্বাস নিতে পারছে। মানুষগুলো সব খাঁচার ভেতর, পাখিগুলো উড়ছে!দুপুরে একটু শুয়ে অভ্যাসবশতঃ ফেসবুক খুলল নীলিমা।করোনা সংক্রান্ত নানা সাবধানবাণীতে ফেসবুক ছেয়ে গেছে।কিছু মানুষ আবার সময় কাটাতে নাকি মানসিক চাপ কমাতে নিজের নাচ-গান-আঁকা-রান্না ইত্যাদির ছবি পোস্ট করেছে।কেউ কেউ আবার একাল -সেকালের ছবি পোস্ট করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।এসব নিয়ে তর্ক বিতর্কও চলছে সমানতালে!সবাই আগুনের গোলার ওপর দাঁড়িয়ে আছি।কখন যে নিয়তি কাকে পোড়ায়,তা ভোলার জন্যেই কি এতো আয়োজন?আমরা কি আতঙ্কে পাগল হয়ে যাচ্ছি?বিকৃতি দেখা দিচ্ছে আমাদের মধ্যে?বন্ধুদের অনেকেরই ছেলে-মেয়ে দেশের বাইরে বা ভিনরাজ্যে আছে।সবাই আতঙ্কিত।তাদের খোঁজ খবর নিয়ে ভারাক্রান্ত মনে ফেসবুক বন্ধ করলো নীলিমা।
টিভিতে খবর চলছে,—সারা ভারতে– ১৬৫৭ মানুষ করোনায় আক্রান্ত, মৃত ৩৫।ভারত স্টেজ থ্রিতে ঢুকতে চলেছে।।নীচে ক্যাপশন,উত্তরবঙ্গের প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী মৃত।বাসন্তী পুজো,নবরাত্রি।নীচতলার অবাঙ্গালী পরিবার মা দুর্গার আরতি করছে প্রাণপণে।—প্রায় অন্ধকার ঘরে তিনটি প্রাণী,ওরা তিনজন হাতে হাত রেখে বসে আছে।হঠাৎ কোথাও শঙ্খ বেজে উঠলো জোরে।পাঞ্চজন্য!যুদ্ধের শঙ্খনিনাদ কি?দেবীর সাথে দানবের,প্রকৃতির সাথে সভ্যতার নাকি জীবনের সাথে মৃত্যুর? জয়ী হবে কে? উত্তর দেবে মহাকাল।
বৈশাখী বসু রায়।
মিলন পল্লী। শিলিগুড়ি।